যেখানে তিন সাগরের মোহনায় দেখা মেলে তিন রঙের জলের ধারা – কন্যাকুমারী – Kanyakumari: এখানে এলে তামিল কবির মূর্তি আর বিবেকানন্দর রক মেমোরিয়াল এড়িয়ে যেতে পারবে না চোখ। যেন বারবার হাত বাড়িয়ে ডাকছে— “আয়ে আয়ে।” ভৌগোলিকভাবে এতটাই সংগীত হয়ে এই জায়গাটি আসলে গোটা দুনিয়াতেই বিরল। যেখানে তিনটি সাগরের মিলন হয়েছে। এখান থেকে তিন সাগরের তিন রঙের পানির যে ধারা, সেটি খুব সহজে আলাদা করা যায়।
সমুদ্রপথের এই পাথর দিয়েই স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন সাঁতার কেটে। আরব সাগর, ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরের পাড়ে এসে একেবারে সুমিষ্ট। এসেও আম খেতে খুবই ভালো লাগে। ভারতের সর্ব দক্ষিণের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যমণ্ডিত শহর কন্যাকুমারী থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আমি সালাউদ্দিন সুমন।
কন্যাকুমারী
বন্ধুরা, কন্যাকুমারী এমন একটি জায়গা যেখানে মিলিত হয়েছে তিনটি সাগর। শুধু সাগর যে এখানে মিলিত হয়েছে তাই নয়, তিন সাগরের তিন ধরনের জলের রং এখানে দাঁড়ালে দেখা যায়। এছাড়া, এখানে সমুদ্র উপকূল থেকে কিছুটা দূরে সমুদ্রের মধ্যে একটি ছোট্ট দ্বীপের মতো যেটিকে বলা হয় স্বামী বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল।
যেখানে স্বামী বিবেকানন্দ একসময় বসে ছিলেন। তার স্মৃতিতে তৈরি করা সেই রক মেমোরিয়াল দর্শনার্থীদের জন্য দারুণ একটি জায়গা। সেখানে ফেরিতে করে যেতে হয়।
এছাড়া, এখানে তামিলের বিখ্যাত একজন কবির বিশাল মূর্তি রয়েছে। এখানে বেশ কিছু মন্দির রয়েছে। রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত অনেক কিছু। এই নগরীতে বন্ধুরা, আজকের ভিডিওতে সবকিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
তখনো ভোরের আলো ফুটেনি। কন্যাকুমারীর আকাশে মোহনীয় এক নীলাভ আবছা আধার। চারিদিকে পাশের গির্জা থেকে ভেসে আসছে প্রভাতের প্রার্থনার আওয়াজ। সমুদ্র তখনও শান্ত, স্নিগ্ধ। শনিবির মিটিমিটি তারার মতো আলো জেলে স্নিগ্ধ সাগরে ভাসছে।
হাজারো মাছ ধরার নৌকা। এরই মাঝে আলোয় উদ্ভাসিত দ্বীপ দেখছেন। এটাই স্বামী বিবেকানন্দের রক মেমোরিয়াল। ধীরে ধীরে ফর্সা হতে থাকলো আকাশ। সূর্যোদয় দেখতে হোটেলগুলোর ছাদে অথবা তীরবর্তী সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিতে থাকলেন পর্যটকরা। আমাদের হোটেলের লোকেশনটি এতই ভালো যে এর ছাদ থেকেই মোটামুটি সবকিছু দেখা যায়।
আরও পড়ুনঃ ইলেকট্রনিক বর্জ্য সমাচার – Electronic waste or E-waste
পূর্ব আকাশে সূর্যমামা যথাসময়ে উদিত হলেন ঠিকই, কিন্তু মেঘমালার মোটা আস্তরণ কিছুতেই তাকে সামনে আসতে দিলো না। তবে নরম আলো ঠিকই ঠিকরে পড়লো সমুদ্রের গায়ে। এ যেন স্বর্গীয় দৃশ্য। আলো ফুটার সাথে সাথে অভাবনীয়, অকল্পনীয় রূপে চোখের সামনে ধরা দিল তিন সাগরের রানী হিসেবে পরিচিত ভারতের তামিলনাড়ুর সর্বদক্ষিণের সর্বশেষ সমুদ্র শহর কন্যাকুমারী।
কন্যাকুমারীর একটি বাড়ি, এক রঙে রাঙানো অসাধারণ। শহরের স্থাপত্যের এই জায়গাটিতেই অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে। অধিকাংশ হোটেলই মানসম্মত। মানিকগঞ্জ থম নামের এই হোটেলেই উঠেছি আমরা। ডাবল বেডের সুন্দর রুম, প্রতি রাতের ভাড়া পনেরশো টাকা।

হোটেল থেকে বের হয়ে এখন যাচ্ছি তিন সাগরের যে মিলনস্থল, সেটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। এই কন্যাকুমারীর আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের মিলন ঘটেছে এখানে। সেই জায়গাটি দেখার জন্য পর্যটকরা ব্যাকুল হয়ে থাকেন। আমরাও ব্যাকুল হয়ে আছি।
এই যে নিলয় আর আমি, দুইজন একসাথে যাচ্ছি। শুরুতে এসে দেখি, তারপর অন্য স্পটগুলো ঘুরে দেখাবো। তিন সাগরের যে একটা কনফিডেন্স, এটা আমি দেখবো সচক্ষে। এটা ভাবতেই আমার কেমন লাগছে।
কন্যাকুমারী পৌঁছানোর পর থেকেই একটা গুজব কাজ করছে যে আমি তিন সাগরের মিলন দেখবো। এটা বিশাল একটা ব্যাপার। এরকম জায়গা পৃথিবীতে খুব কমই আছে যে একটা জায়গায় তিনটা সাগরের মিলিত প্রবাহ আসলে হয়। এই তিন সাগরের যেখানে মিলন হয়েছে, সেই জায়গায় নাকি পানির রংও আলাদা। তো এতে ওর পানির রঙের পার্থক্য বোঝা যায়। দেখি আমরা আজকে গিয়ে বুঝতে পারি কিনা।
বন্ধুরা, দেখুন শঙ্খসহ আরও কত কিছু। এই সিরিজগুলো দেখতেও কিন্তু দারুণ। এই যে এগুলো দেখুন, এগুলো অসাধারণ দেখতে। জানি না দাম কত করে। রাস্তার ধারে এভাবে রাখা হয়েছে এগুলো। আর খুব সুন্দর সুন্দর শঙ্খ রয়েছে।
এই যে দেখুন, শঙ্খগুলো বিশাল বিশাল। আর এখানে অনেক দোকান রয়েছে। এই যে দেখুন, ইচ্ছা করলে ঘুরতে এলে পর্যটকরা যাতে কিনতে পারে, সেই ধরনের অনেক আকর্ষণীয় জিনিসপত্র এখানে রয়েছে। এই যে এদিকে দেখুন, কত কিছুর জিনিসপত্র। আপনারা যখন এই তিন সাগরের মোহনার দিকে যাবেন, রাস্তার পথে এই যাওয়ার পথেই কিন্তু এই দোকানগুলো পেয়ে যাবেন।
৩ সাগরের মিলনস্থলে যাওয়ার রাস্তার দুই পাশের পাহাড়ি পণ্যের দোকানগুলো যে কারো নজর কাড়বে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটি সড়কপথে প্রবেশ করলাম। আসলেই এটি কন্যাকুমারী আরুর মেঘু ভগবান মন্দিরের পথ। এর পাশ দিয়ে যেতে হয় ৩ সাগরের মোহনায়। এখন সেদিকেই যাচ্ছি। পরে অবশ্যই ঢুঁ মারবো মন্দিরে।
বিশেষ নিবন্ধ: নদী বিজ্ঞান River science, Erosion and Deposition
বন্ধুরা, চলে এসেছি। দেখুন এমন একটি জায়গায়, যেখান থেকে একসাথে দুটি দর্শনীয় স্থাপনা দেখা যাচ্ছে। একটি হচ্ছে এই যে দেখুন— এটি সংস্কার করা হচ্ছে। এটি তামিল কবি তিরুভাল্লুভারের ভাস্কর্য, যেটি বিরাট ভাস্কর্য। আর তামিল কবির পাশেই যে জায়গাটি দেখতে পাচ্ছেন, সেটির নাম হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল।
এইখানে যে বিশাল পাথর, পাথরের উপরে একটি ছোট্ট মন্দিরের মতো দেখা যাচ্ছে। এবং সেখানে এই বিশাল পাথরের গায়ে নাকি স্বামী বিবেকানন্দের নাম লেখা রয়েছে। তিনি যখন কন্যাকুমারীতে এসেছিলেন, তার জীবদ্দশায় তখন সেই পাথরের উপরে বসে ধ্যান করেছিলেন। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই জায়গাটি পরবর্তীতে সংস্কার করে এই রূপ দেওয়া হয়।
এই দুটি জায়গায় আমরা যাব। এখানে যাওয়ার জন্য ওই যে দেখুন, ফেরি রয়েছে। ওই ফেরিতে চড়ে ওখানে যেতে হবে। কিন্তু তার আগেই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ৩ সাগরের মিলনস্থল। সেখানে যাওয়া একেবারেই কাছে। চলুন, আমরা এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আপনাদেরকে আরো কাছে গিয়ে ভালোভাবে দেখাতে চাই।
বন্ধুরা, অবশেষে চলে এসেছি সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত, বহুল প্রতীক্ষিত জায়গাটিতে। এই যে আমার পিছনে যে জায়গাটি দেখছেন, এদিকে তামিল ভাষায় বলা হয় “ত্রিবেণী সংঘম,” অর্থাৎ তিন সাগরের মিলনস্থল। আপনাদের আগেই বলেছি, এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে তিনটি সাগর মিলিত হয়েছে। এই সেই জায়গা।
এবং এই যে দেখুন, এখানে সাগরের ঢেউ। একটু সাদার মতো দেখাচ্ছে, দেখুন। এটি বঙ্গোপসাগরের পানি। আর ঠিক মাঝখানে নীলাভ রঙের পানি, এটি ভারত মহাসাগরের পানি। আর একেবারে শেষের দিকে কালচে রঙের পানি, এটি আরব সাগরের পানি। ৩ সাগরের মিলনস্থলে এসে নিজ চোখে তিন ধরনের জল দেখতে পারা রীতিমতো অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে।
ভারত মহাসাগর, আরব সাগর আর বঙ্গোপসাগরের জল মিলিত হয়ে এখানে যে উন্মাদনার সৃষ্টি করেছে, তা দেখার মতো। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র ছোট-বড় পাথরের গায়ে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। একের পর এক ঢেউ। এ কারণে পর্যটকরা এখানে এসে বিমোহিত হয়ে যান।
এখানে এলে তামিল কবির মূর্তি আর বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল এড়িয়ে যেতে পারবে না চোখ। যেন বারবার হাত বাড়িয়ে ডাকছে, “আয়, আয়।” কিছুক্ষণ পর ফেরিতে অবশ্যই সেখানে যাব। আগে এখানে যা যা আছে, তা দেখে নিই দুচোখ ভরে। ৩ সাগরের মোহনায় বসে মনটা একেবারে ফুরফুরে হয়ে গেছে।
ভৌগোলিকভাবে এতটাই সংগীত হয়ে এই জায়গাটি আসলে গোটা দুনিয়াতেই বিরল। এরকম জায়গা পৃথিবীতে খুব কমই আছে, যেখানে তিনটি সাগরের মিলন হয়েছে। এই জায়গাটি সেই দুনিয়ার বিরল স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে।
এখানকার বাতাস আর ঢেউ— এই যে ঢেউ দেখতে পাচ্ছেন— এই অংশটি বঙ্গোপসাগর। আর এই পাশেই তামিল কবির বিশাল ভাস্কর্য। তার পাশেই সেই বিখ্যাত বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল। সবকিছু মিলিয়ে এখানে যখন আপনি বসে থাকবেন, ১০ মিনিট বসলেই আপনার মন অন্যরকম এক ভালো জায়গায় ঘুরে যাবে।
বন্ধুরা, এই ৩ সাগরের মিলন যেখানে হয়েছে, ঠিক সেই জায়গায় একটি মন্দির রয়েছে। এটি শ্রী কাঞ্চি কমাকোটি পীঠম মন্দির। আমরা এই ৩ সাগরের মোহনা আপনাদের দেখানোর পরপরই এই মন্দিরটিও কিছুটা দেখানোর চেষ্টা করবো।
আর বলে রাখি, একেবারে মোহনার কাছে যে স্থাপনাটি দেখা যাচ্ছে, এটি প্রাচীন। আমার মনে হয়, এটি মন্দিরেরই অংশ হয়ে থাকবে। দেখুন, অনেক প্রাচীন স্থাপনা। মন্দিরের ঠিক কিনা জানি না, তবে পাথরগুলো দেখেই মনে হচ্ছে এটি খুবই প্রাচীন। এই প্রাচীন স্থাপনাটি অনেক সুন্দর। আর এই স্থাপনার পাশেই হচ্ছে ৩ সাগরের মোহনা।
এখানে পাথর দিয়ে নির্মিত কয়েকটি সুন্দর ঘাট রয়েছে। এসব ঘাটে অনেকেই পণ্য স্থানান্তরের জন্য নামেন। এই জায়গা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে খুবই পবিত্র। তারা এখানে এসে ধর্মীয় অনেক রীতিনীতি পালন করে থাকে।
এই পশ্চিমপাশটায় কালো জলের আরব সাগর। এখানেও ভারত সাগরের জল মিশে আলাদা স্তর তৈরি করেছে। এই পাশেও ঢেউয়ের যেন তাণ্ডব চলছে অবিরাম। বন্ধুরা, এখানে এলে আপনারা দেখুন কত সুন্দর আম। কি সুন্দর আম এখানে রাখা হয়েছে। সব কেমন জানি না।
হিমসাগরের মরশুম শেষ হলে এরকম ফার্মের অনেক দোকান দেখতে পাবেন। ফার্ম থেকে যা নিতে পারবেন, তা ফার্মেসিতে আম দেয়া হয়েছে। এই যে দেখুন, এই আমটি হচ্ছে ৬০ রুপি দাম। ষাট রুপি দিয়ে এরকম আম আপনারা কিনতে পারবেন। তো আম আমার খুব খেতে ইচ্ছে করছে। একটু দেখাই আপনাদেরকে। দারুণ রঙ। খেতে কেমন লাগে!
খুব দেশি। দেশে তো আমের সিজন শেষ, কিন্তু আরব সাগর, ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরের পাড়ে এসে একেবারে সুমিষ্ট দেশীয় আম খেতে খুবই ভালো লাগছে। দেশীয় আম মানে তোমার দেশের আম? হ্যাঁ, আমার দেশের না, মানে একটা দেশি আমের স্বাদ পাচ্ছি।
এই ঘাটে পণ্যার্থীদের গোসলের ভিড়। সকাল থেকে কিশোর থেকে বৃদ্ধ— সবাই ঢেউ তরঙ্গে স্নান করছেন। আর এদিকে এই দাদু স্নান শেষে দমকা বাতাসে লুঙ্গি শুকিয়ে নিচ্ছেন। ব্যাপারটা আসলেই মজার। এখানে সুপেয় পানির অনেকগুলো ট্যাপ রয়েছে। পাশাপাশি ফ্রেশ ওয়াটারের বাথরুম ও চেঞ্জিং রুমও রয়েছে।
কি সুন্দর পথ! মনে হচ্ছে কার্পেট বিছানো। এই পথে আমরা যাচ্ছি ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সম্মানে নির্মিত মেমোরিয়ালে। সমুদ্রের জলে বিসর্জনের আগে তার দেহাবশেষ এই জায়গাটিতে রাখা হয়েছিল। সংগত কারণে ভারতীয়দের কাছে এই জায়গাটি খুবই শ্রদ্ধার আর আবেগের।
মহাত্মা গান্ধী তার জীবদ্দশায় দুইবার কন্যাকুমারী পরিদর্শন করেছেন— ১৯২৫ সালে এবং ১৯৩৭ সালে। ১৯৪৮ সালে তার মৃত্যুর পর তার দেহাবশেষ বা ছাই বারোটি ভিন্ন কলসে রাখা হয়েছিল, যাতে সেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর করা যায়। এর মধ্যে একটি কলস কন্যাকুমারীতে আনা হয়েছিল।
বিসর্জনের আগে এখন যেখানে এই স্মৃতিসৌধটি দেখছেন, এখানেই রাখা হয়েছিল দেহাবশেষ, যাতে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারেন সাধারণ মানুষ। পরে ছাইগুলো ভারত মহাসাগরের জলে বিসর্জন করা হয়। এরপর ১৯৫৬ সালে এই মহাত্মা গান্ধী স্মৃতিসৌধ বা গান্ধী মণ্ডপম নির্মিত হয়।
আরও পড়ুনঃ ঋতু পরিবর্তন এবং মরুভূমি Season change on earth and Desert
সামনে থেকে দেখতে এই মহাত্মা গান্ধী মণ্ডপম খুবই সুন্দর। যারা ঘুরতে আসেন, বিশেষ করে ত্রিবেণী সংঘমের কাছে, তাদের অবশ্যই গন্তব্য হয়ে যায় এই মণ্ডপটিও। কারণ এটি দেখতে অনেক সুন্দর।
আরেকজন এখানে আসেন এবং এর উপরে উঠে যান। উপর থেকে ত্রিবেণী সংঘমের ৩ সাগরের মোহনা খুব ভালোভাবে দেখা যায়। এখান থেকে অনেকে ছবি তোলেন। আমরা একটু ঘুরে আসতে চাই ভিতর থেকে। এই মণ্ডপমে প্রবেশের কোনো ফি নেই। তবে জুতো রাখার জন্য ৫ টাকা দিতে হয়।
জুতো রেখে খালি পায়ে আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করলাম ভেতরে। একেবারেই শান্ত পরিবেশ। মণ্ডপমের ভেতরে চারিদিকে গ্যালারির মতো। আর মাঝখানে বৃত্তাকার দাগের মধ্যে যে সারবস্তু দেখছেন, এখানেই রাখা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর দেহাবশেষ।
বিশাল গ্যালারিতে রাখা হয়েছে মহাত্মা গান্ধীর কর্মময় জীবনের অনেক আলোকচিত্র। স্থান পেয়েছে শিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা চিত্রকর্ম। এই মেমোরিয়ালটি উড়িষ্যার স্থাপত্যশৈলী থেকে অনুপ্রাণিত আধুনিক স্থাপত্যের একটি চমৎকার উদাহরণ।
পরিপাটি সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই চোখ জুড়িয়ে গেল চারপাশ দেখে। আরো ভালোভাবে চারপাশ দেখতে হলে উঠতে হবে আরো উপরে। উপরে ওঠার পর মনে হলো সুউচ্চ কোনো ওয়ার্ল্ড টাওয়ারে উঠেছি। দেবী কন্যাকুমারী মন্দির, রক মেমোরিয়াল, পথঘাটসহ আশপাশের সবকিছু এখান থেকেই দৃশ্যমান। আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো।
এখান থেকে দেখা সমুদ্র, তিন সাগরের মোহনা। এখান থেকে পুরোটা দেখা যায়। শুধু তাই নয়, আলাদা সাগরের আলাদা জলের রং এখান থেকে আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। মহাত্মা গান্ধী মণ্ডপ থেকে সাগরের রং দেখে, তিন সাগরের তিন রং দেখে আরো স্পষ্টভাবে দেখে খুব ভালো লাগলো।
এখন আপনাদের আমি নিয়ে যাব এখানকার সেই শ্রামি বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালে। সেটি দেখাবো এবং সেখান থেকেই কাছে হবে সেই তামিল কবির যে ভাস্কর্য থেকে এখন সংস্কার করা হচ্ছে, সেটিও দেখাবো। চলুন বন্ধুরা, এর জন্য আমাদেরকে একটি ফেরিতে উঠতে হবে। ফেরিতে করেই বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালে যেতে হবে।
বন্ধুরা, দেখুন কৃত্রিমভাবে বানানো বাবুই পাখির বাসা। এখানে বিক্রি হচ্ছে। এটা কিন্তু মানুষের হাতে বানানো, আঠা দিয়ে তৈরি। বাবুই পাখির অরিজিনাল বাসা দেখতে যতটা সুন্দর, ততটা নয়। তবে ওই রকম বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখানে বিক্রি করা হচ্ছে মার্কেটে অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর মধ্যে। এই যে দেখুন, এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি বাবুই পাখির ছোট বাসা এবং বড় বাসাগুলো।
এখানে যারা ঘুরতে আসেন, প্রত্যেকেই ফেরিতে করে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালে গিয়ে থাকেন। সেখানে না গেলে যে অদেখাই থেকে যাবে কন্যাকুমারী। ফেরিঘাটে একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছি। আর কিছুক্ষণ গেলেই টিকিট কাউন্টার মিলবে। এরপর ফেরিতে আমরা উঠবো।
টিকিট কত? ৫০ টাকা করে পার হেড। পার হেড ৫০ টাকা। বন্ধুরা, দারুণ একটি সুরঙ্গের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। তারকার চোখ হচ্ছে তো সুরঙ্গ। নিলয় টিকিট কেটে নিয়েছে, প্রতি জনের জন্য ৫০ টাকা করে ফেরির টিকিট। এটি বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালে নিয়ে যাবে এবং সেখান থেকে আবার এখানে এনে নামিয়ে দেবে। এর জন্য ৫০ টাকা করে গুনতে হবে।
আমরা একেবারে ফেরিঘাটে চলে এসেছি। ফেরিতে এখন উঠবো। এই যে দেখুন, এখানে ফেরিগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবাই যাচ্ছেন ফেরির দিকে। পাশাপাশি কয়েকটি ফেরি চলাচল করে, এখানে যাওয়া-আসা করে। এখানে আসার পরপরই ফেরিতে ওঠার আগেই লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকের জন্য লাইফ জ্যাকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক।
নিলয় নিজেই লাইফ জ্যাকেট নিচ্ছে। সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না যে তাকে কেউ দেবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জ্যাকেট বেছে নেওয়ার চেষ্টা করছে। হ্যাঁ, নাও আর পরে নাও। বন্ধুরা, নিলয় লাইফ জ্যাকেট পরে একেবারেই রেডি হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরি ছেড়ে যাবে।
ফেরি থেকে গ্রেপ্তারসহ আশপাশের বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন রূপকথার কোনো নম্বরই নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই ফেরিটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। সবার চোখে-মুখে যেন ফুটে উঠেছে রোমাঞ্চ।
ফেরিটি যখন চলতে শুরু করলো, তখন খুব ভালো লাগলো। দূরত্ব বেশি নয়, মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিটের পথ। তবুও এটি দারুণ অভিজ্ঞতা। ধীরে ধীরে ফেরিটি এগিয়ে যেতে থাকলো বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালের দিকে। রক মেমোরিয়ালের যত কাছে যাচ্ছি, ততই ভালো লাগছে।
ভোর থেকে যে স্থাপনাটি বারবার দেখে আসছি, অবশেষে পৌঁছে গেলাম সেখানে। যাত্রীরা একে একে সবাই নেমে আসছেন। বিশাল পাথরের ছোট্ট দ্বীপে। এখানেও আলাদা করে টিকিট কাটতে হবে। টিকিট দেখিয়ে আমি আর নিলয় প্রবেশ করলাম মেমোরিয়াল কম্পাউন্ডের ভেতরে। এখানেও স্যান্ডেল পড়ে যাওয়া নিষেধ।
তাই সেসব জমা রেখেই সামনে এগোতে থাকলাম আমরা। এখানে জুতো রাখার জন্য অবশ্য আলাদা করে টাকা দিতে হয় না। বন্ধুরা, এখানে আসার পরেও আমাদেরকে টিকিট কাটতে হয়েছে ৩০ টাকা করে। তারপরে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে। টিকিট থেকে এই যে দেখুন, সেই স্বামী বিবেকানন্দ। বিশাল পাথরের উপর নির্ভর এই বিশাল স্থাপনা সত্যিই অসাধারণ।
আঠারোশো ৯২ সালে স্বামী বিবেকানন্দ এই শিলাখণ্ডের উপরে বসে দীর্ঘক্ষণ ধ্যান করেছিলেন। এখানে বসে তিনি ভারতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দীর্ঘক্ষণ ভেবেছিলেন। তারই স্মৃতির উদ্দেশ্যে উনিশশো ৭০ সালে নির্মাণ করা হয় এই রক মেমোরিয়াল। হাঁটতে হাঁটতে যখন এই রক মেমোরিয়ালের সামনে এলাম, এর কারুকাজ, বিশালত্ব আর সৌন্দর্য দেখে রীতিমতো হতবাক বনে গেলাম।
মেমোরিয়ালের সামনে রাখা এই হাতির ভাস্কর্যটি এতই নিখুঁত আর সুন্দর যে দেখে মনে হবে এখনই বুঝি দৌড় শুরু করবে। শুধু হাতিই নয়, এই সিংহের ভাস্কর্যটিও নজর কাড়তে বাধ্য। রক মেমোরিয়ালের সুউচ্চ সিঁড়িতে উপরে উঠতে থাকলাম। প্রবেশদ্বারে এসেই বন্ধ করতে হলো ক্যামেরা, কারণ ভিতরে ক্যামেরা নিষিদ্ধ। এর ভিতরে স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি রয়েছে, যা আমি বাইরে থেকে ধারণ করেছি আপনাদের দেখানোর জন্য।
শিলার উপরে নির্মিত এই স্থাপনায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপত্য রীতির মিশ্রণ দেখা যায়। রক মেমোরিয়ালের সামনে থেকে কন্যাকুমারীর শহরসহ চারপাশ ভালোভাবে দেখা যায়। বিশেষ করে পূর্ব দিকের সীমানায় সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার দৃশ্যটি খুবই হৃদয়গ্রাহী মনে হলো আমার কাছে। এছাড়া সাগরের জলে ভেসে বেড়ানো জলজ প্রাণীগুলো দেখতেও দারুণ লাগছিল।
প্রাচীন তামিল প্রবাদ অনুসারে, এই শিলাতে দেবী কুমারী বসে তপস্যা করেছিলেন। তাই এই শিলার আগেকার নাম ছিল শ্রীপদ পাড়ায়, অর্থাৎ দেবী কুমারীর পদস্পর্শ ধন্য শিলা। কন্যাকুমারীর মূল ভূখণ্ড থেকে পাঁচশো মিটার দূরে সমুদ্রপৃষ্ঠের এই পাথরে স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন সাঁতার কেটে। চিন্তা করুন, লাইফ জ্যাকেট পরে ফেরিতে করে আসতেও যেখানে বুক দুরুদুরু করে, সেখানে এই উত্তাল সাগরে সাঁতার দিয়ে তিনি এসেছিলেন। টানা তিনদিন এখানে ধ্যান করেছিলেন তিনি।
স্বামী বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল থেকে আরও স্পষ্টভাবে আরব সাগর, ভারত সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থল দেখা যায়। এখানে জলের আলাদা রং দেখে খুব সহজেই বোঝা যায় কোনটি কোন সাগরের জল। বন্ধুরা, এখানে যত ঘুরছি এবং যত জায়গায় যাচ্ছি, ধীরে ধীরে এই সমুদ্রের তিন সাগরের মিলনস্থলটি আমার কাছে আরো চমৎকার হয়ে ধরা দিচ্ছে।
যখন তিন সাগরের এই মোহনায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, তখন কালার তো দেখলামই। তারপরে যখন গান্ধীজির মণ্ডপে গেলাম, সেখান থেকে আরও স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এরপর যখন এই স্বামী বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালে এসেছি, এখানে দাঁড়িয়ে রীতিমতো আমি হতবাক। দেখুন, এই যে নীল পানি দেখতে পাচ্ছেন এ পাশে, তারপর ওই যে মাঝখানে একটু সাদা মতো ঘোলাটে পানি। তার উপরে দেখুন কালো পানি। এখান থেকে তিন সাগরের তিন রঙের পানির যে ধারা, সেটি খুব সহজে আলাদা করা যায়।
আমরা যেমন শ্রীমঙ্গলে গেলে কয়েকটি স্তরের চা খাই, যেখানে একেক স্তরে একেক রঙের চা থাকে, ঠিক সেরকম মনে হচ্ছে। এখানে তিন রঙের পানি দেখতে পাচ্ছি। ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে যখনই কোনো পর্যটক আসেন, তারা একেবারে মুগ্ধ হয়ে যান এখানকার এই রং ও রূপ দেখে।
সমুদ্রের বুকে দ্বীপে এটি একটি মিঠা পানির জলাধার। মনের বাসনা পূরণে এই পানিতে কয়েন নিক্ষেপ করেন পর্যটকরা। এই স্থাপনাটি হল চৌ স্থাপত্য রীতির একতলা মন্দির। এই মন্দিরের ভিতরের গর্ভগৃহে রয়েছে দেবী পার্বতীর পায়ের ছাপ। কথিত রয়েছে, শিবকে পাওয়ার জন্য এখানে এক পায়ে তপস্যা করেছিলেন দেবী পার্বতী।
এই মন্দিরের ভিতরেও ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই কিছুই দেখাতে পারলাম না আপনাদের। দেবী পার্বতীর পায়ের ছাপের পাথর ঘেরা মন্দিরের পাশ থেকে খুব ভালোভাবে দেখা যায় প্রাচীন তামিল কবি তিরুভল্লুভরের ১৩৩ ফুট উঁচু মূর্তি। তবে দুর্ভাগ্যবশত সংস্কার কাজ চলায় মূর্তিটি ভালোভাবে দেখতে পেলাম না।
স্বামী বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল দেখে এবার কন্যাকুমারীর ভূখণ্ডে ফেরার পালা। অপেক্ষামান ফেরিতে অনেকেই ফিরে আসতে থাকলেন। এখানে কয়েকটি ফেরি সারাক্ষণ যাতায়াত করে। টিকিট থাকলে যে কোনো ফেরিতে চেপেই ফেরা যায়।
এই সামান্য পথের অসামান্য অনুভূতির যাত্রা মনে থাকবে আজীবন। ফেরি থেকেই কন্যাকুমারী শহরকে আবারও দেখে নিলাম। ২০০৪ সালের সুনামিতে এই শহরের বহু মানুষ হারিয়ে গেছে। অল্প সময়ে ফেরিটি ঘাটে ভিড়ে এলো। সংক্ষিপ্ত অথচ দারুণ এক অভিজ্ঞতার শেষে আমরা ফেরি থেকে নেমে হাঁটতে থাকলাম শহরের দিকে। চলে এলাম কন্যাকুমারী মন্দিরের কাছে। এই মন্দিরেও কোনোভাবেই ছবি তুলতে দেওয়া হয় না। তাই তা দেখানো সম্ভব হলো না।
জানিয়ে রাখি, কন্যাকুমারীর আরলমেগো ভগবান মন্দিরে প্রবেশ করলে জুতোর পাশাপাশি শরীরের উপরের অংশের পরিধেয় বস্ত্র খুলে ফেলতে হয়। নিয়মটা শুধু পুরুষদের জন্য।
কন্যাকুমারীর বিভিন্ন নিদর্শন দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্ত যাবে সূর্য। এবার আমরা একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ছুটছি শহরের পশ্চিম প্রান্তের দিকে, যেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই আমরা জায়গামতো পৌঁছে গেলাম। শত শত মানুষ এখানে ভিড় করেছেন সূর্যাস্ত দেখার জন্য।
এই তিন সাগরের রানি কন্যাকুমারী এমন একটি জায়গা, যেখানে একই সাথে সানরাইজ এবং সানসেট, অর্থাৎ সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত, দুটি এই উপকূলে বসে আপনি দেখতে পারবেন। সকালে আমি সানরাইজ দেখিয়েছি, এখন দেখতে এসেছি এই সানসেট। সূর্যাস্ত আর দেখুন, কত মানুষ এখানে ভিড় করছেন দেখার জন্য।
শৈবাল আচ্ছাদিত সবুজ পাথরের এই সৈকতটিও দারুণ। এখানকার শেষ বিকেলের বাতাস মনটা উদাস করে দিলো। যে মেঘের কারণে সকালে সূর্যের মুখ দেখতে পারিনি, একই কারণে অস্ত যাওয়ার বেলায়ও দেখা মিলল না। তাতে অবশ্য আমার মনে কোনো খেদ নেই। কন্যাকুমারীর অপরূপ সৌন্দর্য যে আমাকে পাগল করে দিয়েছে!
Comments ২