পৃথিবীতে বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা Artificial Intelligence রাজত্ব চলছে। ধীরে ধীরে বিশ্বের সকল সেক্টরে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। শিক্ষাঙ্গণ থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মহাকাশ থেকে সমুদ্রের গভীরে পৌছে গেছে এর ব্যবহার। কিন্তু আমরা কি আসলেই জানি কি এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোথা থেকে এবং কি এর ভবিষ্যৎ? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
আজকে আমরা খুব সহজে বোঝার চেষ্টা করব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, অর্থাৎ যাকে বাংলায় বলা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই জিনিসটা আসলে কী? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের একেবারে গভীরে গিয়ে খুব সহজভাবে জিনিসটা বোঝার জন্য আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence)

বর্তমান পৃথিবীতে আশ্চর্যের এক নাম এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। বাংলায় আমরা যাকে বলছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থাৎ যে বুদ্ধিমত্তা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়নি, যা কৃত্রিমভাবে তৈরি করে কোনো কিছুর মধ্যে দেওয়া হয়েছে, সেটাই মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
আরও সহজ করে বললে, মানুষ বা কোনো প্রাণীর মধ্যে যে বুদ্ধিমত্তা দেখা যায়, সেটা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বুদ্ধিমত্তা হয়ে থাকে। কিন্তু এর বাইরে আমরা যখন কোনো কম্পিউটার, মেশিনকে, মানুষ কিংবা কোনো প্রাণীর মতোই বুদ্ধিমানভাবে তৈরি করতে চাই, সেটা দিয়ে এমন কোনো কাজ করিয়ে নিতে চাই, যেটা করার জন্য বুদ্ধির প্রয়োজন হয়, তখনই এই এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিষয়টা সামনে আসে।
আরও পড়ুনঃ ডিপসিক বনাম চ্যাটজিপিটি বিতর্কের অবসান – Deepseek vs ChatGPT
এআই এর ইতিহাস
এআই-এর আধুনিক ধারণাটা প্রথম সামনে আসে ১৯৫০ সালের দিকে, যখন কম্পিউটার বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম একজন সফল বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং প্রকাশ করেন তার রিসার্চ পেপার Computing Machinery and Intelligence। এই ব্যাপারটি পরবর্তীতে কম্পিউটারের বুদ্ধিমত্তা যাচাইয়ের জন্য অন্যতম জনপ্রিয় পদ্ধতি, যাকে টুরিং টেস্ট বলা হয়, সেটারও স্বীকৃতি নিয়ে আসে।

পরবর্তীতে উনিশশো ছাপ্পান্ন সালে, মেশিন বা কম্পিউটারের বুদ্ধিমত্তা বোঝাতে প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দটির ব্যবহার করা হয়।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের পিছনে অনেকগুলো বিজ্ঞানীর অবদান লক্ষ্য করা যায়। অ্যালান টুরিং ছাড়াও জন ম্যাকার্থি, মারভিন মিনস্কি, অ্যালেন নিউয়েল, হারবার্ট সাইমন অন্যতম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজনীয়তা
অনেকের মনেই হয়তো এই প্রশ্নটা আসতে পারে—মেশিন বা কম্পিউটারকে কেন মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে হবে? সাধারণ অর্থে কম্পিউটার একটি গণনাকারী যন্ত্র হলেও, বর্তমান আধুনিক বিশ্বে কম্পিউটার মোটেও শুধুমাত্র গণনাকারী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় না।
কম্পিউটারের ব্যবহার তার থেকেও অনেক বেশি ব্যাপক। আধুনিক সভ্যতার প্রতিটা ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার পরিলক্ষিত। অর্থাৎ কম্পিউটার ছাড়া বর্তমান বিশ্ব একেবারেই অচল—এটা আমরা সকলেই জানি।
কম্পিউটারের এত এত কাজের ভিড়ে কিছু কিছু এমন কাজও আছে, যেগুলোর জন্য কম্পিউটারকে নিজে থেকেই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আর যখনই নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বিষয় সামনে চলে আসে, তখনই প্রয়োজন হয় বুদ্ধিমত্তার।
অর্থাৎ, কম্পিউটারকে দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে, তাকে অবশ্যই সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট বুদ্ধিমান করে গড়ে তুলতে হবে। তার ভিতরে বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারটি থাকতে হবে। আর এখানেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারটি কাজ করে।

মনে করুন, আপনি মেশিন দিয়ে ডেলিভারি ম্যানের কাজ করাবেন। তার জন্য আপনি কী মেশিন তৈরি করলেন? তাতে চাকা লাগালেন, চাকা ঘোরানোর জন্য মোটর লাগালেন এবং সেই মোটর চালানোর জন্য তাতে ব্যাটারিও সেট করলেন।
নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাতে বসালেন একটি কম্পিউটার। এখন কি আপনার মেশিন পণ্য ডেলিভারির কাজের জন্য একেবারে তৈরি? মোটেও না। কারণ আপনি তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব কমান্ড বা নির্দেশ ইনপুট দিয়ে রেখেছেন, রিয়েল ওয়ার্ল্ডে কাজ করার সময় এর বাইরে অনেক বিষয় আপনার মেশিনের সামনে আসবে, যা আপনি আগে থেকেই তাকে বলে দিতে পারবেন না।
আপনার ডেলিভারি মেশিন রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তার সামনে গাড়ি, ঘোড়া চলে আসতে পারে বা রাস্তায় কোনো বড় গর্তও থাকতে পারে। অথবা গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য একাধিক রাস্তাও থাকতে পারে। কোথায় গর্ত থাকবে, কোথায় গাড়ি, ঘোড়া বা মানুষ সামনে এসে পড়বে কিনা, সেগুলো আপনি আগে থেকেই কি বলে দিতে পারবেন? এগুলো কখনোই বলা সম্ভব না।
এখন, আপনার মেশিনকে এইসব ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আপনি যদি না দেন, সে যদি নিজে থেকেই এই সিদ্ধান্ত দিতে না পারে যে কোন পথে গেলে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে বা সামনে কোনো বাধা পড়লে কিভাবে সেই বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, তাহলে আপনার তৈরি করা এই ডেলিভারি মেশিন কখনোই কাজে আসবে না বা সঠিকভাবে কাজ করবে না।
আর আপনি যদি কোনোভাবে আপনার পণ্য ডেলিভারির এই মেশিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা দিয়ে দিতে পারেন, তাহলে সেটার সামনে কোনো বাধা আসলে সে নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে পাশ কাটিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।
সামনে গাড়ি, ঘোড়া বা কোনো বস্তু চলে আসলে নিজে থেকেই থেমে যেতে পারবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুনরায় পথ চলতে পারবে। নিজে থেকেই পথ খুঁজে বের করতে পারবে। কোন পথে গেলে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে, সেটার সিদ্ধান্ত সে নিজে থেকেই নিতে পারবে।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, কম্পিউটারকে কেন মানুষের মতো বুদ্ধিমান হওয়া প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই কিভাবে কাজ করে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনেকগুলো ধরন আছে, অর্থাৎ এআই-কে অনেক ভাগে ভাগ করা যায়। একেকটি ধরন বা ভাগ একেক রকম কাজ করতে সক্ষম, কিন্তু সবগুলোর মূল পদ্ধতি একই। আর তা হলো প্রচুর পরিমাণে ডাটা বা উপাত্তের বিশ্লেষণ।
আরও পড়ুনঃ এআই দিয়ে কার্টুন ভিডিও তৈরি ও ইনকাম – Great way to Earn Money by AI Cartoon Video with 5 Free App
সহজ ভাষায় যদি বলতে চাই, এআই হলো ব্যাপক পরিমাণে ডাটার সমষ্টি এবং তা থেকে দ্রুততম সময়ে কোনো তথ্য খুঁজে বের করার অ্যালগরিদম সম্বলিত একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামটি ডাটার সমষ্টিকে রিড করে একটা প্যাটার্ন তৈরি করতে পারে এবং সেটা থেকে শিখে সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের কথা। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের একটি অংশ। মেশিনকে কোনো কিছু শিখিয়ে সেই অনুযায়ী কাজ করানোকে বলা হয় মেশিন লার্নিং।
যেমন মনে করুন, আপনি একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেছেন, যে প্রোগ্রাম অনেকগুলো ফলের ছবি থেকে শুধুমাত্র আপেল আছে—এরকম ছবি খুঁজে বের করবে। তাহলে এখানে আপনার মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের প্রয়োজন হবে। এর জন্য প্রথমে আপনাকে কয়েক হাজার বা তারও বেশি আপেলের ছবি আপনার প্রোগ্রামের মধ্যে ইনপুট দিয়ে দিতে হবে।
প্রোগ্রাম সেই ছবিগুলো থেকে আপেল দেখতে কেমন, তার আকার বা শেপ কেমন, আপেলের রং কেমন—এই সব কিছু শিখবে প্রদত্ত ডাটা থেকে। আপেলের একটা ডাটা-ভিত্তিক প্যাটার্ন তৈরি করবে। পরবর্তীতে, আপনি যখন তাকে অন্যান্য অনেকগুলো ফলের ছবি দেখাবেন, তার মধ্যে কোনটিতে আপেল আছে বা আপেল সম্বলিত ছবি কোনটি, তা সে নিজে থেকেই শনাক্ত করতে পারবে।
সেটা তার পূর্বের শেখা প্যাটার্ন থেকে সহজেই বলে দিতে পারে। আর এভাবেই মেশিন লার্নিং কাজ করে। বর্তমানের আধুনিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিউরাল নেটওয়ার্ক ম্যাসেঞ্জিং পার করে এখন ডিপ লার্নিং-এর যুগে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ, প্রদত্ত ডাটা থেকে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শেখার অনেকগুলো স্তর তৈরি হয়েছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখন একটি সমস্যার সমাধান শুধু একভাবে নয়, বরং একটি সমস্যার একাধিক সমাধান খুঁজে বের করতে পারে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে কম্পিউটার খুঁজে বের করছে নতুন নতুন সমাধান।
আরও পড়ুনঃ DeepSeek Ai কারনে ChatGPT এর দিন শেষ!
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভবিষ্যৎ
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভবিষ্যতটা কী? বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। বলা যায়, এআই-এর সম্ভাবনার তুলনায় তার ক্ষমতা এখন খুবই নগণ্য। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, এআই-এর নতুন নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, এআই আগামী ৪৫ বছরের মধ্যে মানুষকে সবদিক থেকে ছাড়িয়ে যাবে এবং মানুষের সমস্ত কাজকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসতে এর সময় লাগবে মাত্র ১২০ বছর।
হঠাৎ আগামী ১২০ বছরের মধ্যেই কোনো কাজেই আর মানুষকে প্রয়োজন হবে না। যে কাজগুলো এখন মানুষ করছে বা মানুষের তত্ত্বাবধানে করা হচ্ছে, সেই সকল ধরনের কাজ এআই-এর মাধ্যমে কম্পিউটার এবং রোবট দ্বারা করা সম্ভব হবে।

এআই জিনিসটাকে সাইন্স ফিকশন মুভিতে যেভাবে দেখানো হয়, আসলে এআই সেরকম কোনো বিষয় নয়। এআই আসলে কী, এআই কিভাবে কাজ করে না জেনেই অনেকে মনে করেন, ভবিষ্যতে হয়তো এআই মানুষ জাতিকে ধ্বংসই করে দেবে। মানুষের সাথে রোবটের তুমুল যুদ্ধ হবে এবং সেই যুদ্ধে মানবজাতি পরাজিত হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা পরিচালিত রোবটদের কাছে।
এগুলো আসলে বাস্তবে কখনোই সম্ভব নয়। এমনকি এগুলো শুধুই মানুষের কল্পনা। বাস্তবে এআই-কে সহজ ভাষায় প্রকাশ করতে চাইলে বলতে হবে—এআই হলো একটা টুল। টুলের কাজ হলো কোনো কাজকে সহজ করা।
কোনো জটিল কাজ, যা সাধারণত মানুষের পক্ষে কঠিন বা সময়সাপেক্ষ, সেটাকে সহজে ও দ্রুততম সময়ে করার জন্য যে যন্ত্র বা জিনিস বা হাতিয়ার আমরা ব্যবহার করে থাকি, সেটাই মূলত টুল। এআই জিনিসটা এর ব্যতিক্রম কিছুই না।
বিশেষ আর্টিকেল: ডিপসিক এআই ডাউনলোড ও ব্যবহারের নিয়ম – Easy way to DeepSeek AI Download
এটা কোনো কাজকে সহজ করার একটা হাতিয়ার মাত্র। এই হাতিয়ারের কোনো ক্ষমতা নেই মানবজাতিকে ধ্বংস বা ক্ষতি করার। যেমন একটা ছুরি—ছুরিও একটা টুল। কিন্তু একটা টুল বা হাতিয়ার হিসেবে ছুরির নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই কোনো কিছু করার। ছুরি দিয়ে আপনি কেকও কাটতে পারেন, আবার মানুষকে হত্যাও করতে পারেন। আপনি কী করবেন, তার দায় সম্পূর্ণ আপনার। আপনি ছুরির দোষ দিলে সেটা তো গ্রহণযোগ্য হবে না, তাই না?
এআই নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা
এআই-এর ক্ষেত্রেও বিষয়টা এমনই। ‘এআই ভয়ঙ্কর’, ‘এআই মানবজাতির জন্য হুমকি’—এসব ভুল, মিথ্যা গল্প মাত্র। যখন কোনো নতুন টুল আবিষ্কার হয়, তখন মানুষের কিছু কাজ কমে যায়, ফলে কিছু মানুষের চাকরি হারায়। আবার কিছু মানুষের চাকরি পাওয়ার নতুন ক্ষেত্রও তৈরি হয়।
ফলে যাদের চাকরি হারায়, তাদের যে ক্ষতিটা হয়, এটাই এআই-এর দ্বারা সবচেয়ে বড় ক্ষতি মানবজাতির জন্য। তাছাড়া, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আর কোনো ক্ষতিকারক দিক নেই।
আপনি এআই প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহী হলে আমাদের এই বিভাগের আর্টিকেলগুলো দেখুন। আমাদের ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেইজ ফলো করুন।
তথ্যসূত্র: ১. রোয়ার বাংলা, ২. লার্ন উইথ কনক
Comments ৩