পিলখানা হত্যাযজ্ঞ যেভাবে কারণে ঘটানো হয়: চব্বিশে ফেব্রুয়ারি ২০০৯, রাজধানী ঢাকার পিলখানাতে অবস্থিত বিডিআরের হেডকোয়ার্টারের বার্ষিক দরবার সপ্তাহের শুরু উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যথারীতি ৩ দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন, পঁচিশে ফেব্রুয়ারি, পিলখানায় অবস্থিত দরবার হলে উপস্থিত হন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ।
বছরের এই সময়ে সাধারণ সৈনিকেরা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ পান এবং দাবি-দাওয়া উত্থাপনের সুযোগও থাকে। সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে দরবার হলে সেই সভাতেই বিডিআরের সৈন্যরা বিতর্ক শুরু করে। অস্ত্রের মুখে প্রথমে জিম্মি করা হয় বিডিআরের মহাপরিচালকসহ উচ্চপদস্থ কিছু অফিসারকে।
দরবার হলে আটকে পড়া অবস্থায় বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল একে একে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, র্যাব প্রধান এবং ডিজি এফআই প্রধানকে। তিনি বিদ্রোহের (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ) ব্যাপারে জানিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেন।
এরপর কী হলো? কোন দিকে মোড় নিলো ঘটনা? কেন ঘটল? আজকের পর্বে এই বিদ্রোহের পুরো রহস্য জানাবো। গত ১৫ বছর ধরে এই বিদ্রোহ নিয়ে কেন কথা বলা যায়নি, আজ জানাবো সবকিছু। প্রিয় দর্শক, সঙ্গত কারণে আজকের ভিডিওটি ধৈর্য ধরে দেখতে হবে।
পিলখানা হত্যাযজ্ঞ
বিদ্রোহ শুরু হয় সকাল ১০টা ১০ মিনিটে। র্যাবের একটি দল বিডিআরের ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গেটে মোতায়েন করা হয়। এর ঘণ্টাখানেক পর সেনাবাহিনীর একটি অগ্রগামী দল পিলখানায় পৌঁছায়। বিদ্রোহের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ডিএমপি পুলিশ কমিশনার, রমনা জোনের ডিসি এবং লালবাগ থানার ওসিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্টে অবস্থান নিতে আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এত আয়োজনের পরও সেনাবাহিনী, র্যাব বা পুলিশ কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপে যায়নি।
সেদিন দরবার হল থেকে বেঁচে ফেরা লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুজ্জামান বলেন, “সকাল ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিদ্রোহীরা (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ) সুসংগঠিত ছিল না এবং তাদের কাছে ভারী অস্ত্রও ছিল না। তখন পর্যন্ত ডিজিসহ অফিসারদের জিম্মি করেই রাখা হয়েছিল। অথচ দ্রুত পদক্ষেপ নিলে বাঁচতে পারত ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারের প্রাণ।”
এই বিদ্রোহের মাধ্যমে সেদিন সেনাবাহিনীর অত্যন্ত চৌকস কিছু অফিসারকে হত্যা (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ) করা হয়। ভেতরের খবর বলছে, সেদিন কিছু অফিসারকে টার্গেট করে পিলখানা হত্যাযজ্ঞ করা হয়েছে। যদি সেসব কথা সত্যি হয়, তবে বলা যায়, সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহের পরিকল্পনাকারীরা তাদের সম্ভাব্য হুমকিকে নির্মূল করতেই এই বিদ্রোহ ঘটিয়েছে।
বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে মানসিক চাপ বিরাজ করেছিল এবং এতগুলো সেনা অফিসারের মৃত্যু সেনাবাহিনীকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ইতিহাসে এমন বড় হত্যাকাণ্ড? এটা কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? বিদ্রোহীদের তথাকথিত অভিযোগ এবং দাবি-দাওয়াগুলোই বা কী ছিল? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো অজানা রহস্য? কোনো বৈদেশিক শক্তি কি এর কলকাঠি নেড়েছিল?
এই ঘটনায় কারা লাভবান হয়েছিল? এবং এই জঘন্য ঘটনার সুদূরপ্রসারী কোনো প্রভাব কি আছে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি।
বিদ্রোহের কারণ বিশ্লেষণে দুটি দিক পাওয়া যায়। প্রথমত, প্রত্যক্ষ কারণ, যা আপাতদৃষ্টিতে বিদ্রোহের কারণ বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, পরোক্ষ কারণ, যা প্রকৃত কারণ হতে পারে।
প্রত্যক্ষ কারণ:
ঠিক কী কারণে বিডিআরের সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিল, তা ঘটনার সময় সাংবাদিকদের কাছে বিদ্রোহী সৈন্যরা বলেছিল। পরবর্তীতে বিদ্রোহের নেতা ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের একটি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবি-দাওয়াগুলো তুলে ধরে।
বিদ্রোহের পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি সামরিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির রিপোর্টে উল্লেখিত কারণগুলো হলো:
১. ১৯৯১ সালের বিদ্রোহের পর কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিদ্রোহ করে পার পেয়ে যাওয়ার ধারণা বিদ্রোহীদের ইন্ধন যুগিয়েছিল।
২. “অপারেশন ডাল ভাত” ছিল বিডিআরের একটি উদ্যোগ, যা সাধারণ মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করত। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত কিছু বিডিআর সদস্যের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে।
৩. সেনা সদস্য ও বিডিআর সদস্যদের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল। রেশন এবং বেতন বৈষম্য সৈনিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল।
পরোক্ষ কারণ:
প্রত্যক্ষ কারণগুলো বিদ্রোহের আগুন জ্বালালেও, পরোক্ষ কারণগুলো বিদ্রোহের পটভূমি রচনা করে দিয়েছিল।
আপনার নির্দেশ বুঝতে ভুল হয়েছে, আমি দুঃখিত। এখন আমি শুধু আপনার দেওয়া লেখার বানান এবং যতি চিহ্ন সংশোধন করব, কোনো বাড়তি কাজ করব না।
গোয়েন্দা ব্যর্থতা: ২০০৮ সালে নির্বাচনের পূর্ব থেকেই বিদ্রোহী অংশ নেওয়া কিছু মিডিয়ার সদস্য দেশ এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত কিছু বেসামরিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করে আসছিল।
আনিসুজ্জামান খানের বেসামরিক তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই সকল রাজনীতিবিদরা ছিলেন শেখ ফজিলুল কবির তাপস, মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শেখ সেলিম এবং প্রমুখ।
বিদ্রোহের এত পূর্ব থেকেই বিদ্রোহীরা কার সাথে, কী কারণে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল, তার সম্পর্কে হয় পুরোপুরি বেখবর ছিল ইন্টেলিজেন্সি সংস্থাগুলো, অথবা জেনেও চুপ ছিল। বিডিআর ডিটেকটিভ এজেন্সির সদস্যরাও বিদ্রোহের অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এজেন্সি কোনো এক অজানা কারণে সেই সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না।
২৫ তারিখ সাড়ে নয়টায় বিদ্রোহ শুরুর পর, জাহাঙ্গীর কবির নানকের নেতৃত্বে সরকারের প্রতিনিধিরা পিলখানায় আসেন সকাল সাড়ে এগারোটায়। উদ্দেশ্য ছিল পলিটিক্যালি বিদ্রোহীদের ট্যাকল করা।
কিন্তু সৈন্যদের সশস্ত্র বিদ্রোহকে পলিটিক্যালি ট্যাকল করতে গিয়ে ভিতরে আটকে থাকা অফিসারদের প্রাণসংহারের সম্ভাবনাকে আমলে নেওয়া হয়েছিল কিনা, সেই প্রশ্ন সে সময় উত্তাপিত হয়নি।
কিন্তু সরকারের পলিটিক্যাল পদক্ষেপ যে ব্যর্থ ছিল, তা প্রমাণ করে ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনের নির্মম মৃত্যুর ঘটনা।
তিলখানা ট্রাজেডির পর বিডিআর বাহিনী বিলুপ্ত করা হয়। নতুন করে পুনর্গঠিত বাহিনীর নাম হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবি প্রধান করা হয় জেনারেল মঈনুল ইসলামকে, যা সম্পর্কে বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত কার্য বিঘ্নিত করার অভিযোগ রয়েছে।
বিডিয়ার ভেঙে গঠিত হওয়া বিজিবি গত ১৫ বছরে অসংখ্য সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে কেবল পতাকা বৈঠকেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের আটক করেও ফিরিয়ে দেওয়া হতো বিএসএফের হাতে।
সরকারি হিসেবে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল অবধি সীমান্তে ২৯১ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ। এবং ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালে হত্যা করা হয় আরও ২০০-র বেশি মানুষকে।
অথচ দাবি করা হয়ে থাকে এই সময়ে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক গভীর। জেনে নিন ভারত বাংলাদেশের চেয়ে কতটা শক্তিশালী।
সম্পর্ক এতটাই গভীর যে সীমান্তে সদস্যকে খুন করা হলেও আমাদের সীমান্তরক্ষীদের চুপ থাকতে হচ্ছে। পরবর্তীতে এই বিজিবি বাহিনীকে সরকারি বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করতে এবং ভোটারবিহীন সাজানো নির্বাচন সফল করতেও ব্যবহার করা হয়।
এবং সর্বশেষ, জেনস্রি রেভোলিউশনে এই বিজিবিকে ছাত্রজনতার উপরে গুলি চালাতেও দেখা যায়। কিন্তু ফ্যাসিবাদের পতনের সাথে সাথে সীমান্তে ছেড়ে কথা না বলবার মানসিকতা পোষণ করতে দেখা যায়। (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ)
গণমাধ্যমগুলোর খবরে বিএসএফের গুলিতে ১ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরও দুজন। গতরাতে এ ঘটনার কথা পিলখানা হত্যাযজ্ঞ সেই ঘটনার পর সেনাবাহিনীর সক্ষমতা এবং ইমেজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীর সব গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে সরকার দলীয় অথবা সরকারের প্রতি বিশেষভাবে অনুগতশীল লোকদের পদায়ন করা হয় এবং অবারিত দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়।
ফলস্বরূপ, সেনাবাহিনী সরকারবিরোধী হয়ে ওঠার এবং সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
বিডিয়ার বিদ্রোহ (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ)-পরবর্তী সময়ে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (সংক্ষেপে ডিজিএফআই) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল আহসানের মাধ্যমে সরকার দলীয় গুন্ডাবাহিনীতে পরিণত করা হয়।
এই সংস্থা বিরোধীদের দমন করতে অসংখ্য গুম, ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা ঘটায়। ‘আয়না ঘর’ নামক নির্মম টর্চার সেলের উদ্ভাবকও এই সংস্থা।
গত ১৫ বছরে আওয়ামী রেজিম প্রায় সাতশো গুমের ঘটনা ঘটায়, যার অধিকাংশতেই সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর হাত রয়েছে। এভাবেই সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষায় নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুনঃ পাকিস্তানিরা কেন শেখ মুজিবের চেয়ে তাজউদ্দীনকে বেশী ভয় পেতো
পঁচিশে ফেব্রুয়ারি বারোটা তিরিশের দিকে বিডিআর-এর ৩ নম্বর গেটে শতাধিক মানুষ মিছিল দিয়ে যায় এবং তারা বিডিআরদের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে।
এই সময় তাদেরকে “জয় বাংলা”, “জয় মিডিয়া”, “মিডিয়ার জনতা ভাই ভাই” এই ধরনের স্লোগান দিতে শোনা যায়।
এই লোকগুলো কারা, কী কারণে তারা আসলো, এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে স্লোগান “জয় বাংলা”, সেই স্লোগানই বা কেন দিল? কার নেতৃত্বে তারা জড়ো হয়েছিল, এর কোনো কিছুই সরজমিনে তদন্ত করে দেখা হয়নি।
আনিসুজ্জামান খানের তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে কয়েকজন আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদের নাম উঠে এসেছে, যাদের সাথে বিদ্রোহী (বিদ্রোহ) অংশ নেয়া বিডিআর সদস্যরা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং পরে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছিল।
তারা হচ্ছেন, সে সময়ে আওয়ামী লীগের এমপি শেখ ফজলুল করিম তাপস, শেখ সেলিম, মির্জা আজম, এবং আরও অনেকে।
২৬ তারিখে তাপসের নির্দেশে পিলখানার চারিদিকের ৩ কিলোমিটার এলাকা থেকে সবাইকে সরে যেতে বলা হয়। পুলিশ, র্যাব এবং আর্মি সরে যাবার পর খুব সহজেই হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়া সৈন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
পিলখানা হত্যাযজ্ঞ রিপোর্টে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদস্যদের অস্ত্রসমর্পণের পর তাদের কোনো পরিবারের সদস্যদের পিলখানার বাইরে আসতে দেখা যায়নি। অথচ শত শত জেসিও এবং সৈনিকরা তাদের পরিবারের সাথে সেখানকার কোয়ার্টারেই থাকতো।
সুতরাং এটি সুস্পষ্ট যে তাদের ইতিমধ্যেই পিলখানা ত্যাগের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এটাও ধারণা করা যায় যে অধিকাংশ বিডিআর সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা পিলখানা হত্যাযজ্ঞ বিদ্রোহ শুরুর পূর্বেই পিলখানা ত্যাগ করেছে।
সম্প্রতি তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার পরে আওয়ামী লীগ নেতা আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘তোমার নেত্রী তিন খানে আমার বাবা-মাকে জবাই দিয়েছে। তুমি যদি বেশি বাড়াবাড়ি করো, তাহলে তোমাকেও জবাই দেবে।’
আরও জানুন: সীমান্তের ওপারে আগ্রাসী ভারত – কী করবে বাংলাদেশ?
আনিসুজ্জামানের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, অফিসারদের প্রতি সাধারণ সৈন্যদের ক্ষোভ ছিল। কিন্তু কেবলমাত্র সেই ক্ষোভ এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিডিআর বিদ্রোহ () গভীর পরিকল্পনা করে ঘটানো একটি ঘটনা, যার পরিকল্পনা চলেছিল প্রায় দুই মাস ধরে। সামরিক ও বেসামরিক উভয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এবং সম্প্রতি টিভি চ্যানেলে সাবেক সেনা অফিসার ও নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যে কারা ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
বিস্তারিত তদন্ত শেষেও সাবেক সচিব আনসুর জামান খানের তদন্ত কমিটি ঘটনার নেপথ্যে কারা ছিল, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কেন পারেননি, তার একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ডিজিএফআই, এনএসআই প্রভৃতি ইন্টেলিজেন্স সংস্থার অসহযোগিতা। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিকে সরকারি সংস্থা অংশগ্রহণ করবে—এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার, যদি না সরকারের বিধি-নিষেধ না থাকে।
দুটো তদন্ত কমিটির রিপোর্ট, পূর্ববর্তী কিছু ঘটনা, মিডিয়ার বিদ্রোহের ফলাফল এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতি—এই সবগুলো ডট যদি কানেক্ট করা যায়, তবে একটা সম্ভাব্য উত্তর মিলে যাবে। তার পূর্বে আমাদের খুঁজতে হবে, এই ঘটনার বেনিফিশিয়ারি কারা।
২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কোনো প্রকার কারণ ছাড়াই অতর্কিতভাবে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। ওয়ান জিরো সিক্স সেভেন বাই থ্রি পিলারটি অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি উপজেলার বরাইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে এবং বিডিআর ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি ছুটতে শুরু করে।
ঘটনার দিন ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বরাইবাড়ি বিওপিতে ডিউটিতে ছিলেন মাত্র ১১ জন বিডিআর সদস্য। তারাই প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে এবং পরবর্তীতে আশেপাশের বিডিআর ক্যাম্প থেকে আরও জওয়ান এবং গ্রামবাসী তাদের সাথে যোগ দেন।
সে যুদ্ধে ভারতের বিএসএফের একজন অফিসারসহ ১৭ জন নিহত হয়। সেই সাথে বিডিআরের তিনজন জওয়ান শহীদ হন। ধারণা করা হয়, বিএসএফ-এর পক্ষে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। ঘটনাটি পুরো ভারত জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলে এবং এই ঘটনার পর ভারতের ডিফেন্স মিনিস্টার জেসভান সিং উত্তপ্ত লোকসভায় জানিয়ে দেন যে এই ঘটনার বদলা নেয়া হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেই যুদ্ধের প্রতিশোধ কি নেয়া হয়েছিল ভারতের পক্ষ থেকে? ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাবাহিনী বিএসএফ একটি সিভিল ফোর্স। অন্যদিকে তৎকালীন বিডিআর ছিল সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রশিক্ষিত এবং সেনা কমান্ডে পরিচালিত একটি আধাসামরিক বাহিনী।
প্রকৃতপক্ষে বিডিআর-এর সক্ষমতা সেনাবাহিনীর মতোই ছিল, যার ফলে বিডিআর এবং বিএসএফ-এর মধ্যে সক্ষমতার দিক থেকে এক ধরনের ব্যবধান ছিল। আর সে কারণেই যতবার বিডিআর এবং বিএসএফ মুখোমুখি হয়েছিল, বিএসএফকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল।
আরও পড়ুনঃ জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা Climate change and Nobel prize 2021 physics
সুতরাং, আর্মি কমান্ডে পরিচালিত বিডিআরের চোখে চোখ রেখে কথা বলা এবং ইটের জবাব পাটকেল মারার বিষয়টি ভারতের মতো বৃহৎ শক্তির দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সেই সাথে বরাইবাড়ির যুদ্ধ ছিল ভারত সরকারের গালে চপেটাঘাত। তাই বিডিআর নিয়ে ভারত সরকারের ক্ষোভের কারণ সুস্পষ্ট ছিল। ভারত সরকার কখনোই চায়নি, বিডিআর-এর কমান্ড সেনা অফিসারের হাতে থাকুক।
ভারতের এই আকাঙ্ক্ষার সাথে বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানদের আকাঙ্ক্ষাও মিলে যায়। এটা কি কাকতালীয় কোনো ঘটনা? বাংলাদেশের বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাযজ্ঞ প্রায় ২১ মাস পরে, বিডিআর তথা ভারতকে পরাজিত করা বাহিনীকে বিলুপ্ত করা হয়।
অথচ এই বিডিআর বাহিনীর ছিল গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের দুইজন বীরশ্রেষ্ঠ ছিলেন ইপিআর তথা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের। স্বাধীনতার পর পরিবর্তিত নামকরণ হয় বাংলাদেশ রাইফেলস।
আগের বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলসকে বিলুপ্ত করা হয়েছিল। ২০১০ সালের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন নামে নতুন একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে গঠিত হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।
অতএব, যেভাবেই হোক, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে ২০০১ সালে বরাইবাড়ির যুদ্ধে নিহত বিএসএফ সদস্যদের প্রতিশোধ নেয়া হয়ে যায়। অতএব, বিডিআর বিদ্রোহ এবং জওয়ানদের বিডিআর থেকে সেনাবাহিনীকে হটানোর দাবি মোটেও কাকতালীয় নয়, বরং সুপরিকল্পিত।
বিডিআর বিদ্রোহের (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ) ঘটনার সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হয় এবং একসাথে এতগুলো চৌকস অফিসার হারিয়ে সেনাবাহিনী অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
এটা শুধু সেনাবাহিনীর অফিসার নয়, পুরো দেশের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। সেনাবাহিনীর দুর্বলতা তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের জন্য সাপে বর হয়ে দেখা দেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখনই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়েছে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলে তৎপর হয়েছে।
মিডিয়ার বিদ্রোহের পর সরকারের হাতে সুবর্ণ সুযোগ আসে সেনাবাহিনীকে নিজের কব্জায় নিয়ে নেয়ার। গুরুত্বপূর্ণ পথগুলোতে নিজেদের অনুগত লোক বসিয়ে এবং তাদের অপার অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকার সেই সুযোগ খুব চতুরতার সাথে কাজে লাগিয়েছে। এই ফলাফলে আমরা তিনটি বিনা ভোটের সাজানো এবং প্রহসনমূলক জাতীয় নির্বাচন দেখেছি।
এখানে বাকী অংশ: বাংলাদেশ – পৃথিবীর মানচিত্রে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র
সময়সূচী ১৯৪২ সাল, গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারত ছাড়া আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে ব্রিটিশ সরকার অসংখ্য কংগ্রেস নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে এবং আহমেদ নগর ফোর্টে কারাবাস দেয়।
এদের মধ্যে নেহেরু ছিলেন অন্যতম। জেলে বসেই তিনি রচনা করেন “ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া”। এই গ্রন্থের শেষের দিকে নেহেরু ভারতের ভবিষ্যত পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যৎসামান্য আলোচনা করেছিলেন, যা ছিল মূলত অখণ্ড ভারত তথ্য।
এই তথ্য পরবর্তীতে নেহেরু ডকট্রিন নামে পরিচিতি লাভ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর নেহেরু তার এই মতবাদ একটি ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিলেন, যে তথ্যের মূল কথা হলো—অবশ্যই ভারত তার আধিপত্য বিস্তার করবে ভারত মহাসাগরী অঞ্চলে।
ভারত হবে সব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। ছোট জাতিরাষ্ট্রগুলো সাংস্কৃতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকবে, তবে রাজনৈতিকভাবে তারা স্বাধীন থাকবে না।
নেহেরুর পররাষ্ট্রনীতির এই মডেল গ্রহণ করা হয়েছিল মর্যাদাশীল সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মौर্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্যের লেখা অর্থশাস্ত্র থেকে, যার মূল কথা ছিল—রাষ্ট্রের অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে অস্থিরশীল করতে হবে।
কিন্তু ভারত চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধনীতি অনুসরণ করে তার চারপাশের রাষ্ট্রগুলোকে পাপের রাষ্ট্র বানানোর মিশন গ্রহণ করে। আর এই মিশন পূরণের জন্যই গঠিত হয়েছিল রিসার্চ চ্যানেলও আইসিস উইং, সংক্ষেপে রমা।
২০১৩ সালের কার্যকরী নির্বাচনের পর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে একের পর এক অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, প্রতিবেশী সকল স্বার্থ রক্ষা করলেও বিনিময়ে কিছুই পায়নি বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ভারতের এই অসম সম্পর্ক নিয়ে করা একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে শহীদ হতে হয় বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। সর্বশেষ বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতকে দেয়া হয় রেল ট্রানজিট, এবং বাংলা সমুদ্রবন্দরটির নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয় ভারতের হাতে। বিনিময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়ে আসেন কেবল আশ্বাস।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে বাংলাদেশকে ভেসেল স্টেট বানানোর (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ) সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করেছিলেন শেখ হাসিনা। তার বড় প্রমাণ হাসিনার পতনের সাথে সাথে হাসিনাকে আশ্রয়দানসহ ভারতের পক্ষ থেকে নেয়া নানান পদক্ষেপ এবং সর্বশেষ নজিরবিহীন বন্যা।
আরও পড়ুনঃ এসএসসি ২০২৬ সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও মানবন্টন সকল বিষয় পিডিএফ
যদি বিডিআর-এর বিদ্রোহ (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ) না ঘটতো, যদি সেদিন ৫৭ জন সেনা অফিসারকে মেরে ফেলা না হতো, তবে সেনাবাহিনী হাসিনার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ানোর সমূহ সম্ভাবনা ছিল। অতএব, এটা সন্দেহাতীত যে বিডিআর বিদ্রোহের দেশে সুবিধাভোগী শেখ হাসিনা এবং আন্তর্জাতিক সুবিধাভোগী ভারত।
আগে পরের সঠিক ঘটনা, তৎকালীন রিপোর্ট, তথ্য প্রমাণ এবং ভারত-হাসিনা জুটির সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি হাসিনা ও হাসিনাকে আশ্রয়দাতার দক্ষিণ এশিয়ার নতুন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতরেই বিদ্রোহের (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ) নেপথ্যের শক্তি হিসেবে ইঙ্গিত করে।
দর্শক, আপনাদের কি মতামত জানাতে পারেন? কমেন্ট সেকশনে ভিডিওটি পুরোটা দেখার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
Comments ২