প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ একটি দেশ বাংলাদেশ। পৃথিবীর মানচিত্রে উদীয়মান দেশটির নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিতে রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। দেশটি বিখ্যাত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো এর বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নদী।
দক্ষিণ ঈশ্বর খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির রাষ্ট্রীয় নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এবং দেশটির রাজধানী শহর ঢাকা। এদেশের অপরূপ সৌন্দর্যকে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি বিভিন্ন সৌন্দর্যের উপমায় বর্ণনা করেছেন।
ভৌগোলিক পরিচিতি
আজকের বিশ্বপ্রান্তের এপিসোডে আমরা পৃথিবীর সুন্দরতম এই দেশটি নিয়েই জানবো। ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ পঞ্চম হলো এটি। দেশটির মোট আয়তন ১,৪৮,৪৬০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি।

জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। এদেশের প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১,১৪০ জন মানুষ বসবাস করে। এখানে জনসংখ্যার প্রায় ৯৯% মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং ৯০% মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তবে হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের মানুষেরাও এদেশে মিলেমিশে বসবাস করে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
১৯৭১ সালের আগে পৃথিবীর মানচিত্রে এই নামে কোনো দেশ ছিল না। বরং এই অঞ্চলটি পাকিস্তানের একটি অংশ ছিল। এই রাষ্ট্রটির জন্মের পেছনে রয়েছে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাস।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার এবং নৃশংস গণহত্যা থেকে রক্ষা পেতে বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর জন্ম হয় বাংলা-দেশের।
যুদ্ধের স্মৃতি
ভয়াবহ হলেও সত্য, এ স্বল্প সময়ের যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রায় ৩০ লক্ষ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং প্রায় ২ লক্ষ নারী ধর্ষিত হন। তবে গর্বের বিষয় হলো মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করে রাখতে ঢাকা জেলার অদূরে সাভারে একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপন করেছে বাংলাদেশ সরকার।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ
১৫০ ফুট উঁচু কংক্রিট নির্মিত এই স্মৃতিসৌধে সাতটি দিব্যাকৃতির স্তম্ভ রয়েছে। সাতটি স্তম্ভ দ্বারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সাল- ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১-কে বোঝানো হয়েছে।
স্মৃতিসৌধের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো স্থাপনাটিকে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন আকৃতির মনে হয়। এটি শুধু একটি স্মৃতিসৌধ নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স। এখানে রয়েছে আকর্ষণীয় ফুলের বাগান, কৃত্রিম জলাশয়, উন্মুক্ত মঞ্চ, সেতু, হেলিপ্যাড, মসজিদ এবং রেস্টুরেন্ট।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
জেনে অবাক হবেন, প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার মূল অবদান বাংলাদেশের বাঙালি জনগণের। ভাষার জন্য বাঙালিদের জীবন বিসর্জনের মহিমান্বিত নিদর্শনের কারণেই দিনটিকে পৃথিবীজুড়ে ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
শহীদ মিনার
এছাড়াও আন্দোলনকারী শহীদদের বলিদানকে স্মরণ করতে সারা দেশজুড়ে শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরেই শহীদ মিনার দেখতে পাওয়া যায়।
রাজধানী ঢাকা
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ববঙ্গের ঐতিহ্যবাহী নগরী ঢাকাকে বাংলাদেশের রাজধানী করা হয়। রাজধানী মর্যাদা ছাড়াও ঢাকা বাংলাদেশের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক নগরী। এই শহরে প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের বসবাস।
ঐতিহাসিকভাবে ঢাকার গুরুত্ব
মোঘল এবং সুলতানি আমলেও ঢাকাকে কয়েকবার বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ঢাকায় অবস্থিত অনেক স্থাপনা এখনো সুলতানি আমলের ছাপ বহন করে। এরকম একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হলো লালবাগ কেল্লা। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় অবস্থিত এটি একটি মোঘল আমলের স্থাপনা।
লালবাগ কেল্লা
মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব লালবাগ কেল্লা নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এ কেল্লায় তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে এবং ভেতরে রয়েছে মনোরম বাগান, সুবাদার সায়েস্তা খানের কন্যা পরিবিবির সমাধি, মসজিদ, ফোয়ারা, কিছু কবর এবং তৎকালীন সময়ে যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান।
আহসান মঞ্জিল
পুরান ঢাকার স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় আহসান মঞ্জিলকে। ভবনটি তৈরি করতে দীর্ঘ ১৩ বছর সময় লেগেছিল এবং এই ভবনের ছাদের গম্বুজটি ছিল একসময় ঢাকা শহরের সবচেয়ে উঁচু গম্বুজ। পূর্ববঙ্গের তৎকালীন নবাবদের হাতে এই ভবনে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে ওঠে।
বাহাদুরশাহ পার্ক
পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী উদ্যানের নাম বাহাদুরশাহ পার্ক। পূর্বে এর নাম ছিল আন্ডাঘর ময়দান। আঠারোশো ৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজ শাসকরা বিপ্লবী সিপাহীদের লাশ ময়দানের বিভিন্ন গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নীরব সাক্ষী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এখানে একসময় ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করা হতো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই উদ্যানে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
জাতীয় সংসদ ভবন
ঢাকার আরেকটি আশ্চর্য স্থাপনা হলো জাতীয় সংসদ ভবন। প্রখ্যাত মার্কিন স্থপতি লুই আই কানের নকশায় নির্মিত এই ভবনটি জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সের একটি অংশ। এই কমপ্লেক্সের মধ্যে আরও আছে সদস্য বাগান, কৃত্রিম হ্রদ এবং সংসদ সদস্যদের আবাস।
রিকশার নগরী ঢাকা
ঢাকাকে রিকশার নগরী বলা হয়। ঢাকার রাজপথে প্রতিদিন প্রায় ৪,০০,০০০ রিকশা চলাচল করে। মজার বিষয় হলো, প্রায় সবগুলো রিকশায় বিভিন্ন রকম নকশা করা থাকে। এই নকশাগুলো এতটাই অনন্য এবং শৈল্পিক গুণসম্পন্ন যে ইউনেস্কো একে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী।
ঢাকার পরিচিতি
ঢাকার আরেকটি পরিচয় হলো এটি মসজিদের নগরী। ঢাকায় প্রায় ৫,৭৭৬টি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে বাইতুল মোকাররম মসজিদ সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। এ মসজিদটি আটতলা বিশিষ্ট এবং একসাথে প্রায় ৩০,০০০ মুসল্লি সালাত আদায় করতে পারেন। এটি বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ।
ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য বিখ্যাত মসজিদ। এগুলো ধর্মীয় স্থান হওয়ার পাশাপাশি একইসাথে পর্যটন স্থানও বটে। এমন কিছু বিখ্যাত মসজিদ হলো বাগেরহাট জেলার সাত গম্বুজ মসজিদ, নওগাঁর কুসুম্বা জামে মসজিদ, রাজশাহীর বাঘা মসজিদ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ।
ঢাকার মন্দির ও ঐতিহ্য
ঢাকার মসজিদ যেমন বিখ্যাত, তেমনি বিখ্যাত এখানকার মন্দিরও। ঢাকার শরী মন্দির বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি ঐতিহাসিক পূণ্যস্থান এবং জাতীয় মন্দির। ঢাকার শরীফ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ঢাকার ঈশ্বর। অনেকেই মনে করেন, এই ঢাকা শরীফ মন্দিরের নাম থেকেই ঢাকার নামকরণ করা হয়েছে।
সোনারগাঁও: ঐতিহাসিক নগরী
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পর্যটন গন্তব্যেরও কোনো অভাব নেই। এদেশে এমন একটি নগরী রয়েছে, যা বর্তমানে পুরোটাই ঐতিহাসিক পর্যটন শিল্প। ঢাকা জেলার অদূরে সোনারগাঁও নামে এই নগরীটি ছিল বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। তাতি ও কারিগরদের বিশাল জনসংখ্যার সাথে বাংলার বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সোনারগাঁও।
সুন্দরবন
বাংলাদেশে এমন কিছু বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, যা পুরো বিশ্বে বিখ্যাত। এর মধ্যে সুন্দরবনের কথা না বললেই নয়। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যা ১,৩৯,৫০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই বনটি আশ্চর্যজনক গাছপালা এবং পশুপাখির আবাসস্থল।
সুন্দরবনে বাস করে পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই প্রজাতির বাঘ শুধু সুন্দরবনেই পাওয়া যায় এবং এটি বাংলাদেশের জাতীয় পশু।
কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন
বাংলাদেশের আরেকটি সুন্দরতম স্থান হলো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সমুদ্র দেখতে, আনন্দঘন সময় কাটাতে এবং নানারকম বাহারি মাছের স্বাদ গ্রহণ করতে ছুটে আসে। এছাড়াও কক্সবাজারে রয়েছে প্যারাগ্লাইডিং, জেট স্কি এবং ঘোড়ায় চড়ার আকর্ষণীয় সুযোগ।
সমুদ্রে ঘেরা বাংলাদেশের আরেকটি প্রাকৃতিক আশ্চর্য হলো সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এটি বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত একটি প্রবাল দ্বীপ। প্রচুর নারকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন কেন্দ্র। এই সমুদ্র সৈকতের দৈর্ঘ্য ১৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৩ কিলোমিটার। স্থানটি পর্যটকদের কাছে সাগরকন্যা হিসেবে পরিচিত।
কুয়াকাটা ও পাহাড়ি সৌন্দর্য
জেনে অবাক হবেন, কুয়াকাটা দক্ষিণেশ্বর একমাত্র সৈকত, যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। এটি কিন্তু পাহাড়ি সৌন্দর্যের দিক থেকেও পিছিয়ে নেই। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল ভ্রমণ করার সুযোগ কোন পর্যটকই হারাতে চাইবেন না।
বাংলাদেশের সবথেকে উঁচু পর্বতের নাম তাজিন ডং। এর উচ্চতা ৪,১৯৮ ফুট। এছাড়াও, পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি জনপ্রিয় একটি পর্যটন স্থান। এখানে পর্যটক আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে কাপ্তাই রথ এবং কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই রথের স্বচ্ছ ও শান্ত পানিতে নৌকা ভ্রমণ অত্যন্ত সুখকর। রোদের উপরে আছে ঝুলন্ত সেতু। এছাড়াও রয়েছে শুভ রঙের পাহাড়ি ঝরনা।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈচিত্র্য
এসব পাহাড়ি অঞ্চল ভ্রমণ করলে দেখা যাবে পাহাড়ি সৌন্দর্য, আকাশে রঙের খেলা, নানা রকমের পাহাড়ি ঝরনা এবং পরিষ্কার স্বচ্ছ জলের ঝিরি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা উঠলে, বাংলাদেশের পর্যটন স্থানের কোন অভাব নেই।
আরো একটি অসাধারণ স্থান হলো জাফলং। এটি বাংলাদেশের সিলেট জেলার অন্তর্গত। ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ভেসে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি স্থান। পাহাড় আর নদীর অপূর্ব মিলনস্থল হওয়ায় এখানে পরাবাস্তব সৌন্দর্যের অবতারণা করে।
জানুন: ভারত বাংলাদেশের চেয়ে কতটা শক্তিশালী
সিলেটের বিশেষ আকর্ষণ
এছাড়াও সিলেট অঞ্চলে রয়েছে মিঠা পানির জলাবন রাতার গুল। অবাক করা বিষয় হলো, পৃথিবীতে মিঠা পানির যে বাইশটি জলাবন আছে, রাতার গুল জলাবন তার মধ্যে অন্যতম। এই জলাবনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর। এই এলাকাকে বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
এসব ছাড়াও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী পর্যটন কেন্দ্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে। মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। পূর্বে এর নাম ছিল পুন্যবর্ধন বা পুন্যনগর। মহাস্থানগড় একসময় বাংলার রাজধানী ছিল। এখানে মজু, গুপ্ত, পাল ও সেন সাম্রাজ্যের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
এমন আরো একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হল পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকের শেষ দিকে এই বিহার তৈরি করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। এটি তিনশো বছর ধরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য অতি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং নদীকেন্দ্রিক অঞ্চল হওয়ায় জ্ঞানার্জনের জন্য পূর্ববঙ্গ ছিল সবচেয়ে উত্তম স্থান। বাংলাদেশের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছোট বড় মিলিয়ে এদেশে প্রায় সাতশটি নদী রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সরস্বতী ও ব্রহ্মপুত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই নদীগুলো প্রতিটি যেমন একটি পর্যটন স্থান, আবার একই সাথে এই নদীকে ঘিরেই বাংলাদেশের অনেক মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে জন্ম নেওয়া ইলিশ মাছ পৃথিবী বিখ্যাত। এছাড়াও এই মাছটি বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হিসেবে পরিচিত।
আরও পড়ুনঃ পাকিস্তানিরা কেন শেখ মুজিবের চেয়ে তাজউদ্দীনকে বেশী ভয় পেতো
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অগ্রগতি
এই দেশ কিন্তু শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে অনেক উন্নত একটি দেশ। খোদ বাংলা ভাষা প্রায় ১,৩০০ বছরের পুরনো একটি ভাষা। এ ভাষায় রচিত হয়েছে অসংখ্য পৃথিবী বিখ্যাত উপন্যাস।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
কবিতা, গল্প, নাটক এবং গান—বাংলাদেশের সংস্কৃতির আরেকটি অবাক করা বিষয় হলো পিরাউলিয়া এবং বাউল সাধনা। অনেক আধ্যাত্মিক গুরু যুগে যুগে এদেশের সংস্কৃতি এবং শিল্পে অবদান রেখে গেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন লোকায়ত উৎসব, ঈদ, পূজা, নববর্ষ, চৈত্র সংক্রান্তি এবং বিজু বাংলার ঐতিহ্যকে পৃথিবীর বুকে অনন্য করে তুলেছে।
এ প্রতিটি অনুষ্ঠানের সাথেই গান, মেলা, নানা রঙের নকশা এবং নানান স্বাদের খাবার জড়িয়ে রয়েছে। এমনকি নবান্ন উৎসবে নতুন ধান ঘরে তোলা উপলক্ষে তৈরি করা হয় নতুন চালের পায়েস এবং ক্ষীর। শীত আসলেই শুরু হয় বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর মহোৎসব। নববর্ষের নাচ, গান এবং বাহারি স্বাদের খাবার খেয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্যও রয়েছে।
বাংলাদেশের খাবারের ঐতিহ্য
খাবার বরাবরই বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রয়েছে। তাছাড়া বাঙালি জাতি পৃথিবীতে ভোজন রসিক জাতি হিসেবে পরিচিত। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় এদেশের নদী ও খালবিলে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। “মাছে-ভাতে বাঙালি”—এ প্রবাদটি দেশের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে।
বাংলাদেশের মুখরোচক স্ট্রিটফুডও খ্যাতির দিক থেকে কম যায় না। এদেশে পৃথিবী বিখ্যাত কিছু স্ট্রিটফুডের মধ্যে রয়েছে ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, মাখা, হালিম, ডালপুরি ও সিঙ্গারা। মূলত মশলাদার স্বাদের জন্য এই খাবারগুলো এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে গেলেই বিভিন্ন ধরনের এবং বাহারি স্বাদের খাবার পাওয়া যাবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের ঋতু ও প্রকৃতি
বাংলাদেশের অনন্যতার আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো এদেশের আবহাওয়া। পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে রয়েছে ছয়টি ঋতু। মূল চারটি ঋতুর বাহিরেও বাংলাদেশের শরৎ এবং হেমন্ত নামে দুটি ঋতু রয়েছে। প্রতিটি ঋতুর রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য।
এই ছয়টি ঋতু এবং উর্বর মাটির কারণে বাংলাদেশে ফলে নানা রকমের শাক-সবজি, ফুল এবং ফল। ছয় রকমের আবহাওয়ার মিশ্রণের ফলে এদেশ হয়ে উঠেছে নানা রকম পশুপাখির অভয়ারণ্য। বাংলাদেশের মানুষ খুব শান্তিপ্রিয় এবং অতিথিপরায়ণ হয়ে থাকে। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী। তারা কৃষিকাজ করে ফসল উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে।
অর্থনীতি ও শিল্পে বাংলাদেশের অবদান
এটি পৃথিবীর চা উৎপাদনকারী দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। সিলেট এবং মৌলভীবাজারের পাহাড়ি অঞ্চলে অনেক বড় বড় চা বাগানে উন্নতমানের চা চাষ হয়ে থাকে। এছাড়াও ধান, পাট, গম, আলু—প্রায় সব ধরনের ফসলই এদেশের মাটিতে চাষ করা হয়।
দেশটি একসময় অনুন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু এ দেশের মানুষের পরিশ্রমের ফলে এই চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। বর্তমানে এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গার্মেন্টস শিল্প গুলোর একটি। গার্মেন্টস শিল্প থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৩৯.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে থাকে।
বাংলাদেশের বৈশ্বিক সুনাম
বাংলা-দেশ পৃথিবীর অন্যতম জাহাজ রিসাইক্লিং করা দেশগুলোর একটি। চট্টগ্রাম শহরে প্রায় আশিটি জাহাজ নির্মাণ করার কারখানা রয়েছে। এমনকি বাংলা দেশ ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তক এবং অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনুসকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের বয়স কম হলেও এই ভূখণ্ডটি অতি প্রাচীন। পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে দেশটি গর্বের সাথে সেজেছে বিভিন্ন সাজ। ইবনে বতুতা এবং হিমেল সং-এর মত পর্যটকেরা বাংলা নামক ভূখণ্ড ভ্রমণ করে এর সুনাম করে গেছেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর খুব অল্প সময়েই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে উন্নয়নের গতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, অচিরেই দেশটি বিশ্ব রাজনীতিতে অবদান রাখবে।
তবে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং দুর্নীতির মত কিছু সামাজিক সমস্যা আছে। তবে এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান করে দেশটি তার সোনালী গৌরব সমুন্নত রাখুক, এমনটাই কামনা বিশ্ববাসীর।
Comments ৪