আপনি জানেন কি, বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগেই বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার হয়েছিল? বিষয়টি অদ্ভুত শোনালেও এটাই সত্য। ঘটনার সূত্রপাত ১৭০৫ সালে ফ্রান্সিস হক্সবির হাত ধরে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত ৩২০ বছরে বিদ্যুৎ আমাদের জীবনের অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান আধুনিক পৃথিবী বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনা করা যায় না। তবে বিদ্যুতের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে বহু কৌতূহলী মানুষের অবদান রয়েছে।
যদিও আমাদের কাছে বিদ্যুতের বিষয়টি তেমন আহামরি কিছু মনে হয় না, কারণ আমরা জন্মের পর থেকেই বিদ্যুৎ কিংবা বিদ্যুতের ব্যবহার দেখে বড় হয়েছি। কিন্তু আপনি যদি বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর্যায়ক্রমিক ইতিহাস জানেন, তবে বুঝতে পারবেন মানুষ কতটা কৌতূহলী হলে সম্পূর্ণ অজানা কোনো একটি বিষয় আবিষ্কার এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।
বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর্যায়ক্রমিক ইতিহাস
গল্পের শুরু হয় ব্যারোমিটার থেকে, যার মাধ্যমে বায়ুর চাপ নির্ণয় করা হয়। ১৬৭৫ সালে ফ্রেঞ্চ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জাঁ-পিকিকার্ড লক্ষ্য করেন, ব্যারোমিটারে থাকা ১২ মিটার নল নাড়াচাড়া করলে খালি অংশ থেকে অল্প নীল আলো নিঃসৃত হয় এবং নল নাড়ানোর পরিমাণ বাড়ালে সেই আলোও বাড়ে।
এই ঘটনা তৎকালীন রয়াল ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট নিউটনের সহকারী ফ্রান্সিস হক্সবির মনে কৌতূহল তৈরি করে। হক্সবি বুঝতে পারেন, ব্যারোমিটারের পারদের বাষ্প এই আলোর কারণ। তিনি এই আলো অন্যভাবে তৈরি করার চেষ্টা করেন। এর জন্য একটি কাচের গোলকের ভেতর থেকে বাতাস বের করে তার মধ্যে পারদের বাষ্প প্রবেশ করান এবং গোলকটিকে ঘোরানোর ব্যবস্থা করেন। গোলক ঘোরানোর সময় উপরে হাত রাখলে দেখা যায়, গোলকটি গ্লো করছে। এটি ছিল প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি, কারণ একই প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে আবিষ্কৃত ফ্লুরোসেন্ট বাতিও গ্লো করত।
তৎকালীন সময়ে হক্সবির কাছে ধারণা ছিল না কেন পারদের বাষ্পপূর্ণ গোলক গ্লো করে। পরবর্তীতে জানা যায়, গোলক ঘোরানোর ফলে পারদ বাষ্প এবং কাচের ঘর্ষণের কারণে স্থির তড়িৎ (স্ট্যাটিক চার্জ) তৈরি হয়। সেখানে হাত রাখলে চার্জের বিঘ্ন ঘটে, যার ফলে গোলকটি গ্লো করত।
স্ট্যাটিক চার্জ এবং বিদ্যুৎ গবেষণার অগ্রগতি
এছাড়াও, স্ট্যাটিক চার্জের কারণে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা মানুষের জানা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, গ্লাসের দণ্ডকে পশমি কাপড় দিয়ে ঘষলে তা পাতলা বস্তু আকর্ষণ করত। হক্সবির গোলক ছিল একটি চার্জ তৈরি করার যন্ত্র, যেখানে স্থির তড়িৎ তৈরি হতো।
১৭০৫ সালে এই যন্ত্র আবিষ্কারের পর বিভিন্ন ম্যাজিক ট্রিক দেখানোর ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হতো। উদাহরণস্বরূপ, এই মেশিনের মাধ্যমে মানুষ নিজের শরীরে স্ট্যাটিক চার্জ জমা করে আঙুলের মাধ্যমে ধারক পদার্থকে স্পর্শ করলে স্পার্ক সৃষ্টি হতো। এটি দর্শকদের জন্য ছিল অবিশ্বাস্য ঘটনা।
তবে কিছু মানুষ ইলেকট্রিসিটির বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন স্টিফেন গ্রে। তিনি ১৭২০ থেকে ১৭৩০ সালের মধ্যে দেখান, ইলেকট্রিসিটি কিছু পদার্থের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং কিছু পদার্থের মধ্য দিয়ে হয় না। এখান থেকেই বিদ্যুৎ পরিবাহী এবং অপরিবাহী ধারণার উৎপত্তি।
ইলেকট্রিসিটি সংরক্ষণ
হক্সবির মেশিনে ইলেকট্রিসিটি তৈরি হলেও তা সংরক্ষণ করা যেত না। এটি ধরে রাখার চেষ্টা করেন ক্রিয়েটর বেন্ড মুশেনব্রক। তিনি একটি জারে পানি রেখে তাতে তার যুক্ত করেন, যাতে হক্সবির মেশিন থেকে ইলেকট্রিসিটি পানিতে জমা হয়। যদিও বহু চেষ্টার পরও তিনি সফল হননি।
লাইডেন জার এবং ইলেকট্রিসিটি সংরক্ষণের আবিষ্কার
কিন্তু একদিন মুসেনব্রুক জারের উপরে থাকা তারের অংশ স্পর্শ করেন, এবং তখনই একটি বড় মাত্রার শক অনুভব করেন। এই শক অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্র ছিল। ফলে তখনই নিশ্চিত হওয়া গেল যে জারে থাকা পানি ইলেকট্রিসিটি স্টোর করতে পারে। মুসেনব্রুক যেই শহরে এই বিষয়টি আবিষ্কার করেছিলেন, সেই শহরের নাম অনুযায়ী এই জারকে বলা হয় লাইডেন জার। আসলে লাইডেন জারই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ক্যাপাসিটর।
বর্তমান সময়ে সকল ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ক্যাপাসিটরের ব্যবহার রয়েছে, যার কাজ হচ্ছে কিছুটা চার্জ সংরক্ষণ করে রাখা। লাইডেন জারও ঠিক একই কাজ করেছিল। হক্সবির মেশিন থেকে আসা ইলেকট্রিসিটি জারের পানিতে স্টোর হতো। এবং যখনই জারের উপরের অংশ স্পর্শ করা হতো, তখন জারে সঞ্চিত সকল ইলেকট্রিসিটি শরীরের মাধ্যমে ভূমিতে ডিসচার্জ হতো। ফলে তীব্র শক অনুভূত হতো।
মুসেনব্রুকের ইলেকট্রিসিটি স্টোর করতে পারার বিষয়টি দ্রুতই বিস্তার লাভ করে। যদিও তখনও পর্যন্ত ইলেকট্রিসিটি কী বা কিভাবে কাজ করে, তার ধারণা ছিল না। ফলে প্রশ্ন আসে, ইলেকট্রিসিটি স্টোর করলে তা থেকে কেন স্বাভাবিকের চেয়ে তীব্র শক অনুভূত হয়।
ইলেকট্রিসিটির তাত্ত্বিক ভিত্তি এবং ফ্রাঙ্কলিনের অবদান
তখন সামনে আসেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। ফ্রাঙ্কলিনই প্রথম পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জের ধারণা প্রস্তাব করেন। সেই সাথে তিনি বলেন, আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর বিষয়টি মূলত ইলেকট্রিসিটি। এটি প্রমাণ করার জন্য তিনি একটি ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে তাতে বজ্রপাত হলে তার ইলেকট্রিসিটিকে লাইডেন জারে স্টোর করার প্রস্তাব করেন।
যদিও এই এক্সপেরিমেন্ট বাস্তবে কখনোই করা হয়নি, তবে ভিন্নভাবে এক্সপেরিমেন্টটি করা হয়েছিল। ১৭৫০ সালে টমাস ফ্রান্সিস ডেলিভারি এবং জর্জ লুইস প্রায় ৪০ ফুট লম্বা একটি ধাতব দণ্ড খোলা স্থানে স্থাপন করেন এবং দণ্ডের নিচে রাখেন একটি লাইডেন জার। পরবর্তীতে এই দণ্ডে বজ্রপাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
অবশেষে ১৭৫০ সালের ২৩ মে ধাতব দণ্ডে বজ্রপাত ঘটে। এরপর তারা যখন লাইডেন জার আলাদা করতে যান, তখন এতটাই তীব্র শকপ্রাপ্ত হন যে আঙুলের কিছু অংশ পুড়ে যায়। এই এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে যে ইলেকট্রিসিটি এবং বজ্রপাত একই বিষয়। সেই সাথে ইলেকট্রিসিটি এবং ভূপৃষ্ঠের মধ্যে এমন সম্পর্ক রয়েছে যে তারা একে অপরকে আকর্ষণ করে।
অর্থাৎ বর্তমান সময়ের ব্যাটারির ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক প্রান্তের ধারণা আসে ফ্রাঙ্কলিনের হাত ধরে। অবশ্য ফ্রাঙ্কলিন মনে করেছিলেন পজিটিভ চার্জ নেগেটিভ চার্জের দিকে মুভ করে, অর্থাৎ পজিটিভ থেকে নেগেটিভের দিকে তড়িৎ প্রবাহিত হয়। যদিও বাস্তবে ইলেকট্রন অর্থাৎ নেগেটিভ চার্জ মুভ করে, অর্থাৎ নেগেটিভ থেকে পজিটিভের দিকে তড়িৎ প্রবাহিত হয়। কিন্তু এখনো আমরা ফ্রাঙ্কলিনের সেই ধারণাটি ধরে রেখেছি, অর্থাৎ এখনো আমরা গণনার ক্ষেত্রে ধরে নিই যে ধনাত্মক দিক থেকে ঋণাত্মক দিকে তড়িৎ প্রবাহিত হয়।
টর্পেডো মাছ এবং নতুন তড়িৎ ধারণা
গল্পের এই অংশে সামনে আসে একটি মাছ, যার নাম টর্পেডো ফিশ। টর্পেডো ফিশ ইলেকট্রিসিটির মতো তীব্র শক তৈরি করত, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে কোনো স্পার্ক হতো না। ফলে অনেকেই এই শককে ইলেকট্রিসিটি না ভেবে মাছের কামড় মনে করত।
তখন সামনে আসেন হেনরি ক্যাভেন্ডিশ। তিনি ১৭৭৩ সালে টর্পেডো ফিশের শকের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরবর্তীতে ক্যাভেন্ডিশ বলেন, টর্পেডো ফিশ লাইডেন জারের মতো ইলেকট্রিসিটি তৈরি করে। তবে সেক্ষেত্রে ইলেকট্রিসিটির ইন্টেনসিটি কম থাকে। অর্থাৎ তিনি সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা সামনে নিয়ে আসেন, যার আধুনিক নাম হলো তড়িৎ প্রবাহ এবং বিভব পার্থক্য।
ক্যাভেন্ডিশের মতে, টর্পেডো ফিশ হাই চার্জ এবং লো ভোল্টেজের শক তৈরি করে, যার ফলে টর্পেডো ফিশের শকের ক্ষেত্রে স্পার্ক দেখা যায় না। অন্যদিকে লাইডেন জারের বিপরীত ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ লো চার্জ এবং হাই ভোল্টেজ। এই জন্য লাইডেন জার থেকে আসা শকের ক্ষেত্রে স্পার্ক দেখা যায়।
গ্যালভানি, ভোল্টা এবং প্রথম ব্যাটারি
এরপর সামনে আসেন গ্যালভানি এবং ভোল্টা। এ দুইজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে আবিষ্কৃত হয় পৃথিবীর প্রথম ব্যাটারি। লুইগি গ্যালভানি লক্ষ্য করেন, মৃত ব্যাঙের শরীরে ইলেকট্রিসিটি প্রয়োগ করলে ব্যাঙের পেশিগুলো মুভ করে। একই সাথে তিনি এটাও লক্ষ্য করেন যে কোনো প্রকার ইলেকট্রিসিটি প্রয়োগ ছাড়াই শুধু দুটি ধাতু ব্যবহার করে মৃত ব্যাঙের উপরের অংশ এবং নিচের অংশ সংযুক্ত করলে ব্যাঙের পা উপরে-নিচে মুভ করে।
মৃত ব্যাঙের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে গ্যালভানি মনে করেন প্রাণের সাথে ইলেকট্রিসিটি কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ গ্যালভানির সিদ্ধান্ত ছিল, ব্যাঙের শরীর থেকেই ইলেকট্রিসিটি তৈরি হচ্ছে, যার প্রভাবে ব্যাঙের পা মশক করছে। তিনি ইলেকট্রিসিটির নাম দেন “অ্যানিম্যাল ইলেকট্রিসিটি”। গ্যালভানি তার আবিষ্কার ১৭৮৬ সালে প্রকাশ করেন।
কিন্তু গ্যালভানির দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেন আলেসান্দ্রো ভোল্টা। ভোল্টা ব্যাঙ বাদ দিয়ে ব্যাঙে ব্যবহৃত ধাতুগুলো নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন।
বোল্টা এবং গ্যালবানীর গবেষণা
তিনি খেয়াল করেন, দুটি ভিন্ন মেটাল একসাথে জিভে স্পর্শ করালে এক ধরনের শক বা অনুভূতি হয়। তখন বোল্টা দাবি করেন, গ্যালবানির ব্যাঙের পরীক্ষার ক্ষেত্রে যে ইলেকট্রিসিটি তৈরি হচ্ছে, তা ব্যাঙ থেকে নয় বরং মেটাল থেকে তৈরি হচ্ছে। বোল্টার এমন দাবির বিপরীতে গ্যালবানি খুব শক্ত যুক্তি দাঁড় করাতে পারেননি। শেষমেশ বোল্টাকে গ্যালবানির পরীক্ষাটি ব্যাখ্যা করার জন্য ব্রিটিশ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
তবে বোল্টা অন্যের পরীক্ষা ব্যাখ্যা করার সাফল্যে খুব বেশি খুশি ছিলেন না। ফলে তিনি নিজে নতুন কিছু করার চেষ্টা শুরু করেন। বোল্টা তখন দুটি ভিন্ন মেটাল জিভে রাখলে কেন শক অনুভূতি হয় তা বোঝার চেষ্টা করেন এবং খেয়াল করেন যে মেটাল দুটি জিভের মতো ভেজা মাধ্যমে শক সৃষ্টি করে। শুকনো হাত বা ত্বকের ওপর এমন শক অনুভূত হয় না। অর্থাৎ এখানে তরল পদার্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ফলে তিনি একটি পাত্রে পানি নিয়ে তাতে একটি জিঙ্ক এবং একটি সিলভার দণ্ড স্থাপন করেন। তারপর খেয়াল করেন যে এখান থেকেও শক তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ দুটি মেটালের শেষ প্রান্ত একসাথে স্পর্শ করলে সেখান থেকে শক অনুভূত হয়। তখন তিনি পাত্রের সংখ্যা বাড়িয়ে আগের চেয়ে তীব্র শক পাওয়ার চেষ্টা করেন এবং সফল হন।
পরবর্তীতে বোল্টা এই সিটআপটিকে আরও সুসংগঠিতভাবে তৈরি করেন। অর্থাৎ প্রথমে একটি জিঙ্ক ডিস্ক নিয়ে তাতে ভেজা কাগজ রাখেন এবং তার উপর রাখেন সিলভার ডিস্ক। এভাবে তিনি একটি স্তম্ভ বা “পাইল” তৈরি করেন। এরপর পাইলের দুই প্রান্তে দুটি তার সংযুক্ত করলে সেখান থেকে শক্তিশালী শক তৈরি হয়। পাইলের উচ্চতা যত বাড়ানো হয়, শকের তীব্রতা তত বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে পানির পরিবর্তে লবণ পানি ব্যবহার করলে শকের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। আবার অ্যাসিড ব্যবহার করলে শকের তীব্রতা অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়।
পৃথিবীর প্রথম ব্যাটারি
এভাবেই বোল্টা নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেন পৃথিবীর প্রথম ব্যাটারি। বোল্টার আবিষ্কারের স্মরণে ভোল্টেজের একক রাখা হয়েছে “ভোল্ট”। এখানে বলে রাখা ভালো, গ্যালবানি কিন্তু পুরোপুরি ভুল ছিলেন না। মৃত ব্যাঙের শরীরে দুটি মেটাল স্পর্শ করানোর ফলে ব্যাঙের মুভমেন্টের পেছনে ব্যাঙের শরীরে থাকা অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বোল্টার ব্যাটারিতে পানি যে ভূমিকা রেখেছিল, ব্যাঙের শরীরে থাকা অ্যাসিড সেই একই ভূমিকা রেখেছিল, যার ফলে ব্যাঙের পা নড়েছিল। তবে এই বিষয়টি বা রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি গ্যালবানি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
মৃত ব্যাঙের শরীর থেকে ইলেকট্রিসিটি উৎপন্ন হচ্ছে—এটি না বলে যদি তিনি বলতেন ব্যাঙের শরীরে থাকা রাসায়নিকের কারণে ইলেকট্রিসিটি তৈরি হচ্ছে, তবে গ্যালবানি যৌক্তিকভাবে এগিয়ে থাকতেন।
বোল্টার সাফল্য
ভোল্টার সাথে বিতর্কে হেরে গিয়ে গ্যালবানি চাকরি হারান এবং পরবর্তীতে হতাশার মধ্যে ১৭৯৮ সালে মারা যান। ১৮০০ সালে বোল্টা তার আবিষ্কার, অর্থাৎ ইলেকট্রিক পাইলের বিষয়টি প্রকাশ করেন। যদিও সেখানে এই পাইলকে ব্যাটারি বলা হয়নি, কারণ ব্যাটারি শব্দটি তখন ইতোমধ্যেই ব্যবহৃত হতো। কয়েকটি লাইডেন জার একসঙ্গে যুক্ত করা সেটআপকে তখন “ব্যাটারি” বলা হতো।
লাইডেন জার এবং বোল্টার পাইলের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ছিল। লাইডেন জার থেকে এক মুহূর্তে চার্জ রিলিজ হতো, অর্থাৎ এক মুহূর্তেই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে যেত। অন্যদিকে, বোল্টার পাইল থেকে ধারাবাহিক বিদ্যুৎ প্রবাহ হতো। এভাবেই মানুষ ধারাবাহিক ইলেকট্রিসিটি অর্জন করে।
ধারাবাহিক ইলেকট্রিসিটির ব্যবহার
পরবর্তীতে দেখা যায় যে পানির মধ্যে ধারাবাহিক ইলেকট্রিসিটি প্রয়োগ করার ফলে তারের দুই প্রান্তে দুটি গ্যাস তৈরি হচ্ছে—একটি হাইড্রোজেন এবং অন্যটি অক্সিজেন। এর মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে পানি মূলত হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের সংমিশ্রণ।
১৮০৮ সালে রয়েল ইনস্টিটিউটে ডেভি প্রায় দুই হাজার কপার এবং জিঙ্ক প্লেটের মাধ্যমে ৮০০টি বোল্টার পাইল স্থাপন করেন এবং ওই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাটারি তৈরি করেন। এই ব্যাটারির মাধ্যমে ডেভি পর্যায় সারণির আটটি উপাদান আবিষ্কার করেন।
প্রথম ইলেকট্রিক লাইট
১৮০৯ সালে ডেভি তার শক্তিশালী ব্যাটারির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ব্যবহারিক ইলেকট্রিক লাইট তৈরি করেন। ডেভি খেয়াল করেন, ব্যাটারির দুই প্রান্তে কার্বন সংযুক্ত করে প্রান্ত দুটি খুব কাছাকাছি রাখলে একটি নতুন আলো তৈরি হয়।
আরক ল্যাম্প এবং এর প্রভাব
সেখান থেকে খুবই উজ্জ্বল এবং ধারাবাহিক লাইট তৈরি হচ্ছিল। এই লাইটের উজ্জ্বলতা ছিল অত্যন্ত বেশি, যাকে বলা হয় “আর্ক ল্যাম্প”। যদিও আর্ক ল্যাম্প বাসাবাড়িতে ব্যবহার উপযোগী ছিল না, কারণ এখান থেকে খুবই তীব্র আলো তৈরি হতো। ফলে এই আর্ক ল্যাম্প শুধুমাত্র প্রদর্শনী কিংবা খনি বা ডকে ব্যবহার করা হতো। ডেভির এই আর্ক ল্যাম্পের আধুনিক রূপ হচ্ছে পরবর্তী সময়ের ফিলামেন্টভিত্তিক বাল্বগুলো।
ডেভির ল্যাব দুর্ঘটনা
১৮১২ সালের অক্টোবর মাসে ডেভির ল্যাবরেটরিতে একটি দুর্ঘটনা ঘটে, যার ফলে ডেভির চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও কয়েক মাসের মধ্যে ডেভি সুস্থ হয়ে ওঠেন, তবে তখন তার একজন সহকারী প্রয়োজন হয়। ডেভি তখন ইতিহাসের আরেক মহারথী মাইকেল ফ্যারাডেকে সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন।
গ্যালভানিজম এবং গ্যালবানির প্রভাব
মাইকেল ফ্যারাডের আলোচনায় যাওয়ার আগে, গ্যালবানির এনিমেল ইলেকট্রিসিটি নিয়ে কিছু ঘটনা প্রবাহ উল্লেখ করা প্রয়োজন। গ্যালবানির ভাতিজা, গ্যালভানি আলদিনি, তার চাচার এনিমেল ইলেকট্রিসিটি তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মৃত পশুর শরীরে ইলেকট্রিসিটি প্রয়োগ করে পশুর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নড়াচড়া প্রদর্শন করতেন। এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষের বিচ্ছিন্ন দেহে ইলেকট্রিসিটি প্রয়োগ করে বিভিন্ন ভয়ানক বিষয় প্রদর্শন করতেন। দেখা যেত মৃত ব্যক্তি উঠে বসে যাচ্ছে কিংবা গলাকাটা মানুষের শরীর ও মাথা নড়াচড়া করছে। এই বিষয়গুলোকে তখন বলা হতো “গ্যালভানিজম”।
ওই সময় মেরি শেলি এই ঘটনাগুলো দেখে একটি উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৮১৮ সালে প্রকাশ করেন বিখ্যাত উপন্যাস “ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন”। এটি হরর জনরার প্রথম সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস।
ফ্যারাডে এবং মোটরের আবিষ্কার
মাইকেল ফ্যারাডে পৃথিবীর প্রথম মোটর আবিষ্কার করেন। অর্থাৎ তিনি ইলেকট্রিসিটিকে গতিশক্তিতে রূপান্তর করতে সক্ষম হন। তবে ফ্যারাডের আবিষ্কারের কথা বলতে গেলে ডেনমার্কের বিজ্ঞানী হ্যান্স ক্রিস্টিয়ান ওয়ারস্টেডের কথাও উল্লেখ করতে হয়।
১৮২০ সালে ওয়ারস্টেড দেখেন, একটি তার দিয়ে ইলেকট্রিসিটি প্রবাহিত হচ্ছে এবং তার নিচে রাখা কম্পাসের কাঁটা নড়াচড়া করছে। কম্পাস একটি ছোট চুম্বক, যা একটি নির্দিষ্ট দিক বরাবর স্থির থাকে। পার্মানেন্ট চুম্বকের মাধ্যমে কম্পাসের কাঁটার দিক পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু ইলেকট্রিসিটি প্রবাহিত তারের মাধ্যমে কম্পাসের কাঁটা নড়ার ঘটনা নতুন ছিল।
ওয়ারস্টেড বুঝতে পারেন, এখানে ইলেকট্রিসিটি থেকে চুম্বকীয় বল তৈরি হচ্ছে, যার ফলে কম্পাসের কাঁটা নড়ছে। এই পরীক্ষার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় যে ইলেকট্রিসিটি এবং চুম্বকত্ব পরস্পর সংযুক্ত বিষয়। এছাড়াও ওয়ারস্টেড লক্ষ্য করেন, তারের চারপাশে বৃত্তাকারে চুম্বকীয় বল তৈরি হচ্ছে। তবে এই চুম্বকীয় বল কীভাবে কাজ করছে তা বুঝতে পারেননি।
ফ্যারাডের পরীক্ষা এবং মোটরের সৃষ্টি
মাইকেল ফ্যারাডে ওয়ারস্টেডের পরীক্ষার খটকা সমাধান করেন। তিনি একটি পাত্রে পারদ নেন এবং তার মাঝে একটি পার্মানেন্ট চুম্বক স্থাপন করেন। এরপর ব্যাটারির একটি প্রান্ত পারদের সঙ্গে এবং অন্য প্রান্ত একটি তামার তারের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। সেই তারটি পারদের ওপরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ব্যাটারি চালু করতেই দেখা যায়, তামার তারটি পার্মানেন্ট চুম্বকের চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছে।
এই পরীক্ষার মাধ্যমে ফ্যারাডে নিশ্চিত হন যে ইলেকট্রিসিটির কারণে তারের চারপাশে বৃত্তাকারে চুম্বকীয় বল তৈরি হয়। সেই সঙ্গে তিনি আবিষ্কার করেন পৃথিবীর প্রথম মোটর। যদিও এটি প্রাথমিকভাবে ব্যবহার উপযোগী ছিল না, তবে এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ইলেকট্রিসিটি থেকে যান্ত্রিক শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব হয়। ১৮২১ সালে ফ্যারাডে তার এই আবিষ্কার প্রকাশ করেন।
প্যানকেক কুন্ডুলি এবং চুম্বকত্ব
এই সময়েই ফ্যারাডের বন্ধু আন্দ্রে-মারি আম্পেয়ার লক্ষ্য করেন যে প্যানকেক আকৃতির তারের কুণ্ডলিতে ইলেকট্রিসিটি প্রবাহিত করলে তা চুম্বকের মতো আচরণ করে।
এর মাধ্যমে তিনি আগের চেয়ে শক্তিশালী ইলেকট্রোম্যাগনেট পান। তবে এই ক্ষেত্রে তার লম্বা হওয়ার ফলে রেজিস্ট্যান্স আগের তুলনায় বেড়ে যায়, ফলে তিনি একসাথে প্রচুর তাড়না পেঁচিয়ে লোহার দণ্ডের নয়টি অংশে আলাদা আলাদা করে তা পেঁচিয়ে নেন। পরবর্তীতে সেকশন ওয়াইজ ইলেকট্রিসিটি প্রযোজ্য করে দেখতে পান এমন ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তিশালী ইলেকট্রোম্যাগনেট তৈরি হয় এবং এই ইলেকট্রোম্যাগনেটের মাধ্যমে প্রায় তিনশো কেজি ভারী বস্তু উত্তোলন করা সম্ভব ছিল। পরবর্তীতে আরো শক্তিশালী ইলেকট্রোম্যাগনেট তৈরি করে এর মাধ্যমে প্রায় নয়শো কেজি ভার উত্তরণে সক্ষম হন।
এরপর হ্যান্ডেল চিন্তা করেন, ইলেকট্রিসিটি সোর্স থেকে যদি ইলেকট্রোম্যাগনেটকে ধরে রাখা হয়, তবেই তো তার কাজ করবে। অর্থাৎ, তার সংযুক্ত রেখে ইলেকট্রোম্যাগনেটটিকে যদি ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেক্ষেত্রে তো ইলেকট্রোম্যাগনেটটি কাজ করবে। ফলে তিনি ইলেকট্রিসিটি সোর্স থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটি ইলেকট্রোম্যাগনেট স্থাপন করেন এবং ইলেকট্রনিক্সের পাশে রাখেন একটি লোহার দণ্ড এবং এর পাশে রাখেন একটি ম্যাটারলেকস। এরপর ইলেকট্রিসিটি সোর্স থেকে যখন ১ মুহূর্তের জন্য ইলেকট্রিসিটি এপ্লাই করা হয়, তখন দূরে থাকা ইলেকট্রোম্যাগনেট এক মুহূর্তের জন্য সক্রিয় হয় এবং এই ইলেকট্রোম্যাগনেটের ফলে লোহার দন্ডটি ইলেকট্রনিক্সের দিকে আকৃষ্ট হয়। এই আকৃষ্ট হওয়ার ফলে লোহার দণ্ডে যে মুভমেন্ট তৈরি হয়, এই মুভমেন্টের ফলে লোহার দণ্ডটি মেটাল ডিস্কে আঘাত করে, যার ফলে একটি সাউন্ড তৈরি হয়।
এবং এটিই ছিল পৃথিবীর প্রথম ইলেকট্রিক ডোরবেল। সেই সাথে টেলিগ্রামের সূচনা। এখানে যেহেতু দূর থেকে একটা ইলেকট্রোম্যাগনেটকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে, সেহেতু এই ইলেকট্রোম্যাগনেটের মাধ্যমে যথেষ্ট দূরে নির্দিষ্ট ফর্মে সংকেত পাঠানো সম্ভব। যার ধারাবাহিকতায় শ্যামল মোটর তৈরি করেন মোটসকোর্ট, যেখানে অল্প সময়ের ইলেকট্রনিক সিগন্যাল মানে ডট এবং বেশি সময় ইলেকট্রনিক সিগন্যাল মানে গ্যাস। এই ডট এবং গ্যাসের মাধ্যমে যে কোন ম্যাসেজ তারের মাধ্যমে কোন বাহক ছাড়াই পাঠানো সম্ভব হয়। এবং ১৮৪৪ সালের ২৪ মে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে প্রথম অফিসিয়াল মেসেজ অ্যাকশন থেকে অনুষ্ঠানে পাঠানো হয় এবং সে মেসেজটি ছিল: “এটি”।
এভাবে অজানা ইলেকট্রিসিটি মানুষের কাছে আসতে থাকে। সেই সাথে এটিকে কিভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে তার রিভিল হতে থাকে, কিন্তু তখনও কিন্তু ইলেকট্রিসিটি আসলে কি তা জানা ছিল না, তবে কোন ক্ষেত্রে ইলেকট্রিসিটি কেমন আচরণ করছে তা বোঝা যাচ্ছিল। ১৮৬৫ সালে, অর্থাৎ ফেরারের মৃত্যুর ২ বছর আগে, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ম্যাথমেটিক্যালি দেখান যে লাইট সম্পৃক্ত ফেরারের ধারণা সঠিক ছিল। লাইট আসলেই হচ্ছে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভ এবং এ আবিষ্কারের মাধ্যমে পরবর্তীতে তথ্য প্রযুক্তির কল্পনাতীত অগ্রগতির রহস্য উন্মোচিত হয়।
বিদ্যুতের ইতিহাসের পরবর্তী অধ্যায়ে আসেন এডিসন এবং টেসলা। এডিসন এবং টেসলার মধ্যবর্তী দ্বন্দ্বের কথা আশা করি শুনেছেন। তাদের দ্বন্দ্বের মূল বিষয় ছিল এসি এবং ডিসি কারেন্ট। ফেরারের আবিষ্কৃত ইলেকট্রিক জেনারেটর থেকে উত্তম ইলেকট্রিসিটি ছিল ১ মুখে, অর্থাৎ ডিসি কারেন্ট। এই কারেন্টের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক্সের ১ মুখে প্রভাব তৈরি হয়। ফেরারের পরবর্তী সময়ের ডিসি জেনারেটরের উন্নতি হতে থাকে।
হাম্পি ডেইভির আর ক্লেম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে ফিলামেন্ট ভিত্তিক ল্যাম্প তৈরি হয়। এক্ষেত্রে থমাস আলভা এডিসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ফিলামেন্ট হিসেবে বিভিন্ন উপাদান পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন এবং সাসটেনার বা বাল্বের একটি বাজার তৈরি করেন, অর্থাৎ মানুষ তাদের বাসা-বাড়িতে ইলেকট্রিক বাল্ব ব্যবহার শুরু করতে থাকে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে যারা তাদের বাসা-বাড়ি কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বাল্ব ব্যবহার করতে চাইতেন, তাদেরকে উচ্চ ভোল্টেজ ডিসি ইনস্টল করতে হতো। এমন বাস্তবতা এডিসন একটি নির্দিষ্ট স্থানে ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন করে তা বাসাবাড়ি কিংবা বাণিজ্যিক ভবনে বিতরণের চিন্তা করেন।
কিন্তু এক্ষেত্রে ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন করার স্থান, অর্থাৎ পাওয়ারগ্রিড এবং বিতরণের স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে সামনে আসে। ডিসি কারেন্ট বেশি দূর পর্যন্ত ট্রান্সফার করা যেত না, বড়জোর ১.৫ থেকে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত ডিসি কারেন্ট পাঠানো যেত। এর চেয়ে বেশি দূরের ক্ষেত্রে ডিসি কারেন্ট উইক হয়ে যেত। ওই সময়টায় এডিসনের জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানিতে কাজ করতেন নিকোলা টেসলা। টেসলা বিশ্বাস করতেন, বেশি দূরে ইলেকট্রিসিটি পাঠানোর ক্ষেত্রে এসি কারেন্ট একমাত্র সমাধান। তবে এডিসন তা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এডিসনের এমন ধারণার পেছনে কিন্তু কারণ ছিল, ওই সময় প্রাকটিক্যাল ইউসফুল এসি মোটর ছিল না। সেই সাথে এসি কারেন্টের ক্ষেত্রে ইলেকট্রিসিটিকে হাই ভোল্টেজে পাঠানো প্রয়োজন ছিল, যা যেকোনো প্রাণীর জন্য ছিল মরণঘাতী।
এটিএসএনের কোম্পানি থেকে বের হয়ে টেসলা ১৮৮০ সালে তৈরি করেন এসি মোটর, যাকে বলা হয় পোলিফেস ইনডাকশন মোটর। এখন বাসা-বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কোনটি বেস্ট, এসি নাকি ডিসি? এ বিষয়টি নিয়েই এডিসন এবং টেসলার মধ্যে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এসি কারেন্ট কতটা বিপদজনক তা বোঝানোর জন্য সেই সময় কুকুর, ঘোড়ার মতো প্রাণীকে হাইভোল্টেজ এসি কারেন্ট এপ্লাই করে মারা হয়, যেন টেসলার এসি কারেন্ট কেউ গ্রহণ না করে।
যদিও শেষ পর্যন্ত এসি কারেন্টটি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকে, বর্তমানে আমাদের বাসাবাড়ি সহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে এসি কারেন্ট ব্যবহার করা হয়, অবশ্য মোবাইল চার্জ করা সহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডিসি কারেন্টে ব্যবহার রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এসি কারেন্ট ডেঞ্জারাস হলেও এটিকে হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে, যেমন সেকেন্ডে ১০,০০,০০০ সাইকেল সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে হাজার ভোল্টেজের এসি কারেন্টটি ও প্রাণীর কোন ক্ষতি হয় না, তা একটি এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে টেসলা দেখিয়েছিলেন, যা ছিল খুবই এক্সাইটিং একটি বিষয়।
এই ভিডিওতে টেসলার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। লিংক ডেসক্রিপশন বক্সে দেয়া থাকবে। মজার বিষয় হচ্ছে, ওই সময় পর্যন্ত কিন্তু ইলেকট্রন আবিষ্কার হয়নি। ইলেকট্রন আবিষ্কার হয় ১৮৯৭ সালে, যে যেটি থমসনের হাত ধরে। ইলেকট্রন আবিষ্কারের মাধ্যমে বেনজামিনের আইডিয়া, অর্থাৎ পজিটিভ চার্জ মুভ করে, তা যে ভুল ছিল, তা বোঝা যায়। অবশ্যই এরপরেও ম্যাথমেটিক্সে কোন পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়নি, যার ফলে আমরা এখনো তরিত প্রবাহ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ দিকে হয়, তা বিবেচনা করেই ইলেকট্রিসিটির ম্যাচ সমাধান করে থাকি।
বিশ্ব থেকে শুরু করে মানুষ পরমাণু গঠন সম্পর্কে আইডিয়া পেতে শুরু করে। সেই সাথে কন্টাক্ট মেকানিক স্টেপ লাভ করে, যার মাধ্যমে মানুষ ইলেকট্রিসিটিকে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে আরো গভীরভাবে বুঝতে শুরু করে, ফলস্বরূপ প্রযুক্তি দ্রুতগতিতে এগোতে থাকে। সেই সাথে আবিষ্কার হয় সেমি কন্ডাক্টর, যা বিদ্যুৎ পরিবহন এবং অপরিবাহীর মাঝামাঝি আচরণ করে, যার মাধ্যমে ইলেকট্রনের প্রবাহ বা ইলেকট্রিসিটি মানুষের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
ফলস্বরূপ তথ্য প্রযুক্তি ভাবনার চেয়েও বেশি অগ্রগতি করে। একসময়ের জাস্ট ম্যাজিক ট্রিকস দেখানোর একটি উপাদান বর্তমান পৃথিবীর অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। এখানে একটি বিষয় খেয়াল করুন, আমেরিকা কিংবা ইউরোপের দেশগুলোর শুরু থেকেই বিজ্ঞানকে উৎসাহ দিয়ে এসেছে, বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে এসেছে, যার ফলে সেই দেশগুলোতেই বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তি ডেভেলপ করেছে। এবং এর মাধ্যমে তারা সম্পূর্ণ পৃথিবীতে প্রযুক্তির ব্যবসা করতে পেরেছে, পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, নিজেদেরকে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
সুতরাং, বিজ্ঞানকে উৎসাহ দেয়া মানে দেশ কিংবা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা কিংবা বিভিন্নভাবে পোস্টার মুখে চিন্তার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করা মানে দেশ কিংবা জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়া। পৃথিবীর কিন্তু নির্দিষ্ট কোন পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিক নেই, তবে মানুষ তাদের সুবিধার জন্য পূর্ব পশ্চিম দিকগুলো নির্দিষ্ট করে নিয়েছে, সেই সাথে টাইম জোনের মতো বিষয় প্রতিষ্ঠা করেছে।
এখন এই বিষয়গুলো কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে হলে আপনাকে ড্রাগীমা এবং অখ্যাংস বুঝতে হবে। ড্রাগীমা অকামস্য এবং টাইমসন এই বিষয়গুলো বিস্তারিত জানতে এই ভিডিওটি দেখতে পারেন। ভিডিও ভালো লাগলে বিজ্ঞান পাইসি পরিবারে যুক্ত হয়ে সাথে থাকতে পারেন।