ভারত বাংলাদেশের চেয়ে কতটা শক্তিশালী: সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর নির্লজ্জ অপপ্রচার আর উস্কানিমূলক তথ্য সন্ত্রাস দেখলে মনে হয়, ভারত বোধহয় যে কোনো মুহূর্তে বাংলাদেশে আক্রমণ করে বসবে।
ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকার মুখে বড় বড় কথা বললেও, বাস্তবে তারা পাকিস্তান কিংবা চীনের মতো চিরশত্রু দেশের সাথেও সহজে যুদ্ধে জড়াতে চায় না। বাংলাদেশের চেয়ে সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ভারত ৩৩ ধাপ এগিয়ে থাকলেও, তারা কখনোই তাদের পূর্ণ শক্তি দিয়ে বাংলাদেশে আক্রমণ করতে পারবে না।
আর যদি কখনো ভারত বাংলাদেশে আক্রমণ করেও বসে, সেক্ষেত্রে দুই দেশের কার কেমন সামরিক সক্ষমতা আছে তা নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই।
ভারত বনাম বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা কেমন এবং ভারত কেন পূর্ণ সক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশে আক্রমণ করতে পারবে না, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে এই পর্বে। বাংলাদেশ – পৃথিবীর মানচিত্রে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হলেও ভারতের সাথে কিছু বিষয়ে বৈচিত্র আছে।
ভারত বাংলাদেশের তুলনা
ভারত ও বাংলাদেশের সামরিক শক্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে আকার, সক্ষমতা ও সরঞ্জামের দিক থেকে ভারত উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে রয়েছে। সামরিক শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের পরেই ভারতের অবস্থান। ২০২৪ সালে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃত। এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সাইত্রিশতম।
তার মানে, সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ৩৩ ধাপ এগিয়ে। তবে সেই অর্থে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি একেবারেও দুর্বল নয়। কারণ, মালয়েশিয়া কিংবা আরব আমিরাতের মতো ধনী দেশের চেয়েও বাংলাদেশ সামরিক শক্তিতে অনেক এগিয়ে।
ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৭০০০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। আয়তনের দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ২৩ গুণ বড়। ভারতের জনসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৯ গুণ বেশি। ভারতের জিডিপি বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বড়। তাই সামরিক সক্ষমতায় ভারতের এগিয়ে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

সামরিক শক্তি
আধুনিক সামরিক শক্তি মূলত প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, কৌশল এবং অস্ত্রের মানের উপর নির্ভর করে। সেনা সদস্যের সংখ্যা একটি দেশের সামরিক সক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি সামগ্রিক সামরিক শক্তি নির্ধারণের একমাত্র উপাদান নয়।
বর্তমানে, ভারতের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ১৪,৫৫,০০০। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সক্রিয় সেনা সদস্য রয়েছে প্রায় ১,৬৩,০০০। ভারতের রিজার্ভ সৈন্য ১৪,৫৫,০০০, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো রিজার্ভ বাহিনী নেই। ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫,০৭,০০০ এবং বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনীতে প্রায় ৬,৮০,০০০ সদস্য রয়েছে।
বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী অনেকটা রিজার্ভ সৈন্য হিসেবে কাজ করে। আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বের মধ্যে ১ নম্বরে। কারণ, বাংলাদেশ আনসার বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্যারামিলিটারি ফোর্স, যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬,১০,০০০।
ভারতের ট্যাঙ্কের সংখ্যা ৪,৭৩০টি, বাংলাদেশের ট্যাঙ্ক আছে মাত্র ৩২০টি। ভারতের সাজোয়া যান আছে ৮,৬৮৬টি, বাংলাদেশের সাজোয়া যান আছে ১৩০টি। ভারতের বিমান বাহিনীতে মোট বিমানের সংখ্যা ২,১৮২টি, আর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মোট বিমান মাত্র ২১৬টি। ভারতের যুদ্ধবিমান রয়েছে অনেক বেশি।
পাঁচশো একাত্তরটি বাংলাদেশের যুদ্ধবিমান, চুয়াল্লিশটি অ্যাটাক হেলিকপ্টারসহ ভারতের মোট হেলিকপ্টার আছে তিনশো পঁচানব্বইটি। বাংলাদেশের আছে তেহাত্তরটি হেলিকপ্টার। এছাড়া ভারতের পরিবহন বিমান তিনশো উনচল্লিশটি এবং বাংলাদেশের পরিবহন বিমান মাত্র ষোলটি। ভারতের কাছে ফ্রান্সের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমানের মতো আধুনিক বিমান রয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে চীনের তৈরি আধুনিক যুদ্ধবিমান অন্তর্ভুক্ত করেছে।
ভারতীয় নৌবাহিনীতে মোট নৌযানের সংখ্যা দুইশো পঁচানব্বইটি, আর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মোট নৌযানের সংখ্যা ১০০। সতেরোটি ভারতের ফ্রিগেট যুদ্ধজাহাজ আছে, চোদ্দটি বাংলাদেশের সাতটি। ভারতের ডেস্ট্রোয়ার যুদ্ধজাহাজ আছে এগারোটি, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ডেস্ট্রোয়ার নেই। তবে বাংলাদেশের কাছে ডেস্ট্রোয়ারের চেয়ে ছোট আকারের কর্বেড যুদ্ধজাহাজ আছে ছয়টি। ভারতের সাবমেরিন আছে পনেরোটি, আর বাংলাদেশের দুটি। এছাড়া ভারতের টহল নৌযান আছে একশো দশটি এবং বাংলাদেশের টহল নৌযান পঞ্চান্নটি।
এসবের বাইরে, ভারতের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার রয়েছে, যা অগ্নি সিরিজের ব্যালিস্টিক মিসাইল বা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে চালিত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ নয়।
তবে উভয়ের প্রতিরক্ষা নীতি ও কৌশলগত অবস্থান ভিন্ন হওয়ায়, ভারত বনাম বাংলাদেশের সামরিক শক্তির সরাসরি তুলনা করাটা বোকামি।
থ্রি-টু-ওয়ান রুল
সামরিক কৌশল এবং যুদ্ধশাস্ত্রের একটি প্রচলিত নীতি “থ্রি-টু-ওয়ান রুল” নামে পরিচিত। এই নীতির মূল ধারণা হলো, আক্রমণকারী পক্ষকে প্রতিরক্ষাকারী পক্ষের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি সামরিক শক্তি নিয়ে আসতে হয়। কারণ প্রতিরক্ষাকারী পক্ষ সাধারণত ভূখণ্ড, কৌশলগত পয়েন্ট এবং প্রতিরক্ষামূলক কাঠামোর সুবিধা পায়।
সেই সাথে আক্রমণকারী পক্ষকে স্থানান্তর, রসদ সরবরাহ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে লজিস্টিক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। আক্রমণকারী পক্ষের সামরিক শক্তি শুধু আকারে বড় হওয়া যথেষ্ট নয়, বরং কৌশল, প্রযুক্তি এবং মনোবলের দিক থেকেও শক্তিশালী হতে হবে। সাধারণত যারা আক্রমণ করে, তাদের মনোবল প্রতিরোধকারীদের মনোবলের চেয়ে দুর্বল হয়। কারণ প্রতিরোধকারীরা দেশপ্রেম এবং আত্মরক্ষার তাগিদে বেশি অনুপ্রাণিত থাকে, যা তাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়।
সহজ করে বলতে গেলে, একটি দেশ দখল করতে হলে সেই দেশের চেয়ে তিনগুণ সামরিক শক্তি প্রয়োজন। ঠিক এই কারণেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের কোনো সুগঠিত সেনাবাহিনী না থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সুসজ্জিত সেনাবাহিনী এদেশের সাধারণ কৃষক ও শ্রমিক জনতার বিরুদ্ধে লড়াই করে হেরে যায়।
জানুন: পাকিস্তানিরা কেন শেখ মুজিবের চেয়ে তাজউদ্দীনকে বেশী ভয় পেতো
তবে সব সময়, সকল পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষাপটে “থ্রি-টু-ওয়ান রুল” পুরোপুরি সফল নাও হতে পারে। যেমন, আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে সেরা সামরিক শক্তি নিয়েও ভিয়েতনাম, ইরাক এবং আফগানিস্তান যুদ্ধে চরম ব্যর্থ হয়েছে।
ভারত বাংলাদেশের চেয়ে কতটা শক্তিশালী : ভারতের সামরিক সক্ষমতা বাংলাদেশের চেয়ে ৩ গুণ নয়, বরং ৩৩ গুণ বেশি। প্রথাগত সামরিক শক্তির প্রায় সকল ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও, তারা তাদের সেই পূর্ণ সামরিক সক্ষমতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারবে না।
ভারত বাংলাদেশের চেয়ে কতটা শক্তিশালী
পূর্ণ সক্ষমতা নয় কেন
ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করতে না পারার কারণ হলো, ভারত সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়েছে তার চিরশত্রু পাকিস্তান এবং চীনের মতো পরাশক্তিকে কাবু করার জন্য। ভারতে যদি তার পূর্ণ শক্তি বাংলাদেশের পেছনে ব্যয় করে, তাহলে পাকিস্তান আর চীন মিলে ভারতের পশ্চিম, উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্তের বড় অংশ অনায়াসে দখল করে নিতে পারবে।
ভারত তার সামরিক বাহিনীর কত শতাংশ পাকিস্তান ও চীন সীমান্তে মোতায়েন করেছে, তার সঠিক হিসাব জানা যায় না। নিরাপত্তাজনিত কারণেই কোনো দেশ এ ধরনের স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ করে না। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা যায় যে, পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম সীমান্তে “লাইন অফ কন্ট্রোল” (এলওসি) এবং চীনের সঙ্গে উত্তরের সীমান্তে “লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল” (এলএসি)-তে ভারতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা মোতায়েন রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ সীমান্তের ওপারে আগ্রাসী ভারত – কী করবে বাংলাদেশ?
পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের ইতিহাসের কারণে সেখানে সব সময় বহু সংখ্যক সেনা মোতায়েন করা থাকে। অন্যদিকে, উত্তরে চীনের সঙ্গে সীমান্তবিরোধ এবং সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে সেনা সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ভারতকে সবসময় পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে দুই ফ্রন্টে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি রাখতে হয়, যা শারীরিক সম্পদ এবং জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এই বিশাল সামরিক চাপ সামলে বাংলাদেশের মতো আরেকটি বিস্তৃত ফ্রন্টের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া ভারতের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
ভারতের বর্তমান উগ্রপন্থী সরকার বাংলাদেশকে তাদের মতে “উচিত শিক্ষা” দিতে গিয়ে ভারতের প্রধান নিরাপত্তা ও কৌশলগত অবস্থান ত্যাগ করবে বলে মনে হয় না। তারা যতই গোমূত্র পান করুক না কেন, অন্তত এতটা নির্বোধ তারা হবে না বলেই আশা করা যায়।
ভারত বাংলাদেশের চেয়ে কতটা শক্তিশালী
Comments ৪