এলিয়েন নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই, যার ফলে এলিয়েন নিয়ে গল্প-কাহিনীরও শেষ নেই। প্রথম দিকে, মানুষ যখন অপ্রতুল টেলিস্কোপ দিয়ে মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ করছিল, তখন অনেকেই মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠের গঠন দেখে সেগুলোকে এলিয়েনের বসতবাড়ি মনে করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় মঙ্গলের এলিয়েন নিয়ে গল্প প্রচলিত হয়েছে, সায়েন্স ফিকশন বই লেখা হয়েছে, এবং অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি বর্তমানে কিছু মানুষ মনে করেন, নাসা মঙ্গলে এলিয়েনের সন্ধান পেয়েছে এবং ইচ্ছে করেই তা গোপন করছে। অনেকে আবার এলিয়েনের বিষয়ে আগ্রহী না হলেও জানতে চান কেন এখনো মঙ্গলে মানুষ পাঠানো হচ্ছে না।
প্রাচীনকালের মঙ্গল গ্রহ
রাতের আকাশের এই রক্তিম বিন্দুর প্রতি মানুষের কৌতূহল বহু পুরনো। প্রাচীন সুমেরীয়রা একে যুদ্ধ ও প্লেগের দেবতা নিরগাল হিসেবে গণ্য করত। মেসোপটেমিয়ান টেক্সটে একে মৃতদের ভাগ্য বিচারক নক্ষত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রাচীন মিশরীয়রা মঙ্গলের রেট্রোগ্রেড মৌসুম রেকর্ড করে রেখেছিল। প্রতি দুই বছর অন্তর পৃথিবী ও মঙ্গল সবচেয়ে কাছে আসে। তখন পৃথিবী থেকে মঙ্গলকে দেখলে মনে হয়, মঙ্গলের গতি কিছুটা কমে গেছে এবং একসময় পেছনে যাচ্ছে। পরে আবার আগের গতিতে ফিরে আসে। এই ধরনের গতিকে বলা হয় “রেট্রোগ্রেড মৌসুম”, যা পৃথিবী ও মঙ্গলের গতির পার্থক্যের কারণে ঘটে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৭ সালে অ্যারিস্টোটল লক্ষ্য করেন, লাল বিন্দুটি যখন চাঁদকে ক্রস করে তখন এটি চাঁদের পেছনে অদৃশ্য হয়ে যায়। এখান থেকে তিনি বুঝতে পারেন, লাল বিন্দুটি চাঁদের চেয়ে দূরে অবস্থিত। যদিও তিনি আন্দাজ করতে পারেননি, সেটি কতটা দূরে। লাল বিন্দুটি পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্বের প্রায় ২০০ গুণ বেশি দূরে। পৃথিবী ও মঙ্গলের মধ্যবর্তী গড় দূরত্ব প্রায় ২২৫ মিলিয়ন কিলোমিটার।
মঙ্গলের নামকরণ ও আকৃতি
এই লাল বিন্দুটিকে আমরা “মঙ্গল” বলে থাকি। এটি নামকরণ করা হয়েছে প্রাচীন রোমানদের যুদ্ধ দেবতা মার্সের নামে। তাদের কাছে মঙ্গল রক্ত ও যুদ্ধের প্রতীক ছিল। তবে বর্তমানে এটি মানবজাতির মহাকাশ গবেষণার ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচিত হয়।
মঙ্গলের সূচনা হয়েছিল প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে, যখন গ্যাস ও ধূলিকণা একত্র হয়ে মঙ্গলের রূপ নিয়েছিল। মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠে থাকা আয়রন বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে লাল রঙ ধারণ করে। এটি অনেকটা খোলা বাতাসে লোহা মরিচা পড়ার মতো। মঙ্গল পৃথিবীর তুলনায় ছোট গ্রহ, যার আয়তন আফ্রিকা মহাদেশের প্রস্তুতির চেয়েও ছোট। এটি আমাদের সৌরজগতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম গ্রহ।
আরও পড়ুনঃ মঙ্গল যাত্রা All missions on Mars
মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল ও তাপমাত্রা
মঙ্গলের গড় তাপমাত্রা -৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -১৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কারণ হলো মঙ্গল পৃথিবীর তুলনায় সূর্য থেকে দূরে অবস্থিত এবং এর বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত পাতলা। ফলে এটি সূর্যের তাপশক্তি ধরে রাখতে পারে না। মঙ্গলের ম্যাগনেটিক ফিল্ড হারানোর ফলে সূর্যের বিকিরণ সরাসরি মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং এটি আরও পাতলা হয়ে যায়। এর ফলে মঙ্গলের তরল পানি বাষ্প হয়ে মহাকাশে মিলিয়ে যায়।
মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠের বৈচিত্র্য
মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠের মানচিত্রে উচ্চতা নির্দেশ করে মঙ্গলের বৈচিত্র্য বোঝা যায়। একে প্রধানত দুটি অংশে ভাগ করা যায়—উঁচু ভূমি ও নিচু ভূমি। এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় “মারশিয়ান ডাইকোটমি”। মানচিত্রে সাদা রঙে চিহ্নিত অংশগুলো সবচেয়ে উঁচু ভূমি।
এভাবেই মঙ্গলের প্রাকৃতিক ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের কৌতূহল এবং গবেষণার পথ প্রসারিত হয়েছে।
মঙ্গলের অভ্যন্তরীণ গঠন ও ম্যাগনেটিক ফিল্ড
মঙ্গলের কেন্দ্রে আয়রন, সালফার এবং হালকা মৌলিক উপাদান হাইড্রোজেন রয়েছে। মঙ্গলের কেন্দ্র পূর্ব ধারণার চেয়ে বড় এবং কম ঘনত্বসম্পন্ন। ইনসাইট ল্যান্ডার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলের কেন্দ্রে থাকা উপাদানগুলো কীভাবে কাজ করে তা জানার জন্য পৃথিবীতে পরীক্ষা চালানো হয়। বিজ্ঞানীরা আয়রন, সালফার এবং হাইড্রোজেন একত্রিত করে লেজারের মাধ্যমে তাপ এবং ডায়মন্ডের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করেন, যা মঙ্গলের কেন্দ্রের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করে।
পরীক্ষায় দেখা যায়, আয়রন, সালফার এবং হাইড্রোজেন একসাথে দুই ধরনের তরল তৈরি করে, যা আলাদা অঞ্চলে অবস্থান করে। এই তরলগুলোতে কোনো প্রকার গতিশীলতা নেই। এটি অনেকটা পানি ও তেলের মিশ্রণের মতো—তেল উপরে এবং পানি নিচে থাকে। মঙ্গলের কেন্দ্রে এমন ঘটনার ফলে তরল মুভমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়।
পৃথিবীর ক্ষেত্রে, আউটার কোরের তরল সার্বক্ষণিক গতিশীল থাকে এবং এর ফলে “ডাইনামো ইফেক্ট”-এর মাধ্যমে পৃথিবীর চারপাশে ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। কিন্তু মঙ্গলের তরল মিশ্রণ আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে মুভমেন্ট থেমে যায় এবং এর ফলস্বরূপ মঙ্গলের ম্যাগনেটিক ফিল্ড বিলুপ্ত হয়ে যায়।
মঙ্গলের বর্তমান অবস্থা
ম্যাগনেটিক ফিল্ড হারানোর ফলে সূর্যের বিকিরণ সরাসরি মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে আঘাত করে। এর ফলে বায়ুমণ্ডল পাতলা হয়ে যায় এবং মঙ্গলের তরল পানি বাষ্প হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিবর্তনগুলো মঙ্গলকে একসময়ের প্রাণবন্ত গ্রহ থেকে শুষ্ক এবং নির্জীব মরুভূমিতে রূপান্তরিত করেছে।
মঙ্গলের ম্যাপ ও ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য
মঙ্গলের মানচিত্রে দেখা যায়, এটি উচ্চভূমি এবং নিম্নভূমিতে বিভক্ত। এই বৈচিত্র্যকে বলা হয় “মারশিয়ান ডাইকোটমি”। ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা নির্দেশ করে তৈরি মানচিত্রে রঙের মাধ্যমে মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য বোঝা যায়। সাদা অংশগুলো সবচেয়ে উঁচু, যেখানে গাঢ় রঙের অংশগুলো নিচু ভূমি নির্দেশ করে। মঙ্গলের এই বৈশিষ্ট্যগুলো এর অতীতের জটিল ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের ইঙ্গিত দেয়।
মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে, তবে এর জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডল এবং দুর্বল গ্রাভিটি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত নয়। মঙ্গলের গড় গ্রাভিটি পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ৩.৭১ মিটার/সেকেন্ড², যা পৃথিবীর ৯.৮১ মিটার/সেকেন্ড² গ্রাভিটির তুলনায় অনেক কম। এর ফলে সেখানে মানুষের চলাচল ও কাজ করার ধরন ভিন্ন হবে।
দ্বিতীয়ত, মঙ্গলের তাপমাত্রা অত্যন্ত কম। রাতের তাপমাত্রা -১৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়, যা মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক। তাছাড়া, বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের অভাব এবং উচ্চমাত্রার কার্বন ডাই অক্সাইডের উপস্থিতি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বড় বাধা।
মঙ্গলে ভবিষ্যৎ গবেষণা
মঙ্গলে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার জন্য বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে কৃত্রিম ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে। এছাড়া, মঙ্গলে পানির উৎস খুঁজে বের করা এবং তা ব্যবহারযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টাও চলছে।
মঙ্গলের প্রতিটি নতুন আবিষ্কার আমাদের এই গ্রহ সম্পর্কে আরো জানার এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য নতুন পথ খুলে দিচ্ছে।
নীল থেকে বেগুনি, বেগুনি থেকে কালো—এই অংশগুলো হচ্ছে গভীর। এখানে খেয়াল করুন, মঙ্গলের উত্তর গোলার্ধের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নিচু ভূমি এবং দক্ষিণ গোলার্ধের উঁচু ভূমি। তার মানে, মঙ্গলে যখন পানি ছিল, তখনই উত্তর গোলার্ধে বিশাল সাগর ছিল।
মঙ্গলের উঁচু ভূমিতে মূলত তিনটি বিষয় আলাদা করে উল্লেখ করা যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আগ্নেয়গিরি। মঙ্গলের যতগুলো আগ্নেয়গিরি রয়েছে, এর সবগুলোই বর্তমানে মৃত। মঙ্গলের এই অংশে আগ্নেয়গিরির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এখানে পাশাপাশি পাঁচটি বিশাল আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এদের নাম যথাক্রমে পারসিয়ামন্স, বাবনী, স্মন্সনেস, ক্রিয়াস মন্স, এলবামন্স এবং ওলিম্পাস মন্স।
এই ওলিম্পাস মন্স হচ্ছে আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি। এর উচ্চতা প্রায় ২২ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বত এভারেস্টের উচ্চতার আড়াই গুণ। এই ওলিম্পাস মন্স যে শুধুমাত্র বিশাল উচ্চতার তা-ই নয়, এটি বিস্তৃত এলাকাজুড়ে রয়েছে। এর ব্যাস প্রায় ৬০০ কিলোমিটার, অর্থাৎ বাংলাদেশের পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত দূরত্বের সমান। তবে বিস্তৃতির দিক থেকে মঙ্গলের সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি হচ্ছে এলবামন্স।
মঙ্গলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে গিরিখাদ। গিরিখাদ হচ্ছে এমন স্থান যেখানে দুই পাশের স্থলভাগ উঁচু থাকে, কিন্তু মাঝখানের অংশটি নিচু থাকে। কোনো একটি স্থান বা গ্রহের অতীত ইতিহাস জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে পাথরের স্তর স্টাডি করা। পাথরের প্রত্যেকটি স্তরে ওই সময়ের পরিবেশ কেমন ছিল তার চিহ্ন লুকিয়ে থাকে।
এখন পাথরের স্তর দেখার সবচেয়ে চমৎকার স্থান হচ্ছে গিরিখাদ। মঙ্গলের মাঝখানে রয়েছে বিশাল এক গিরিখাদ, যার নাম ভ্যালিজ মেরিনারিস। এটি লম্বায় প্রায় উত্তর আমেরিকার সমান এবং গভীরতায় প্রায় ৪ কিলোমিটার। ধারণা করা হয়, আগ্নেয়গিরির ফলে মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠের ক্রাস্টে প্রচুর স্ট্রেস জমা হয়েছিল, যার ফলে ক্রাস্ট ভেঙে গিয়ে এই গিরিখাদ তৈরি হয়েছিল।
মঙ্গলের তৃতীয় উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ক্রেটার বা গর্ত। যদিও মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যে যাদের সলিড সারফেস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ক্রেটার খুবই সাধারণ একটি বিষয়, যেমন চাঁদেও এমন ক্রেটার দেখা যায়। সেই হিসেবে পৃথিবীতেও এমন ক্রেটার থাকার কথা, কিন্তু পৃথিবীতে এমনটা দেখা যায় না।
আসলে বলতে গেলে, পৃথিবীর ক্রাস্ট খুবই নতুন। সেই সাথে এখানে পানির প্রভাব থাকার ফলে তা পলির প্রভাব ফেলে। তাছাড়া সক্রিয় আগ্নেয়গিরির মতো বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে, যার ফলে পৃথিবীর সারফেস তুলনামূলকভাবে মসৃণ। অন্যদিকে মঙ্গলে এসব বিষয় অনুপস্থিত, যার ফলে ক্রেটারগুলো অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়ে গেছে। মঙ্গলের সবচেয়ে বড় ক্রেটার হচ্ছে হেলাস প্লানিটিয়া। এখানেই মঙ্গলের সবচেয়ে গভীর ক্রেটারটির অবস্থান, যার গভীরতা প্রায় ৯ কিলোমিটার।
বর্তমানে এটি শুষ্ক হলেও, একসময় এই ক্রেটার পানিপূর্ণ বিশাল এক লেক ছিল। এখন মঙ্গলের এই বিষয়গুলো জানার পর আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে—মঙ্গলের মতো প্রায় বৈচিত্র্যহীন একটি গ্রহের প্রতি কেন মানুষের এত আগ্রহ?
আমাদের সৌরজগতের বাইরের দিকে চারটি বিশাল গ্রহ—জুপিটার, স্যাটার্ন, ইউরেনাস এবং নেপচুন—এসব গ্রহই গ্যাস দিয়ে তৈরি। এর মানে এই গ্রহগুলোর কোনো সলিড সারফেস নেই, সুতরাং এই গ্রহগুলোতে ল্যান্ড করার সুযোগ নেই।
এবার সূর্যের কাছের গ্রহগুলো বিবেচনা করলে প্রথমেই আসবে মার্কিউরি। এতে সলিড সারফেস থাকলেও এটি সূর্যের খুব কাছে হওয়ার ফলে মার্কিউরির তাপমাত্রা খুবই বেশি। মার্কিউরির গড় তাপমাত্রা প্রায় ১৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মার্কিউরির পরবর্তী গ্রহ হচ্ছে ভেনাস। এটি সূর্যের চেয়ে দূরে অবস্থান করলেও এর তাপমাত্রা মার্কিউরির চেয়েও বেশি। এমনকি এটি হচ্ছে সৌরজগতের সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রহ। এর গড় তাপমাত্রা প্রায় ৪৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মার্কিউরির চেয়ে ভেনাসের তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে ভেনাসের বায়ুমণ্ডলের প্রধান উপাদান কার্বন ডাই অক্সাইড, যা গ্রীনহাউস গ্যাস হিসেবে কাজ করে। এর মানে এটি তাপ ধরে রাখতে পারে, এবং এই জন্যই ভেনাস এত উত্তপ্ত।
এখন মার্কিউরি এবং ভেনাসের উচ্চ তাপমাত্রার ফলে এগুলো প্রায় অকেজো। তাহলে আমাদের সৌরজগতের সলিড সারফেস থাকা একটি গ্রহই অবশিষ্ট থাকে, এবং তা হচ্ছে মঙ্গল।
মঙ্গল পৃথিবীর কাছের একটি গ্রহ। এর তাপমাত্রাও সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এটি প্রাণের জন্য সহায়ক বা হ্যাবিটেবল জোনে অবস্থিত। নিশ্চিতভাবে জানা গেছে, মঙ্গলের অতীতে তরল পানি ছিল। এছাড়া, মঙ্গলে মিথেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা প্রাণ থাকার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।
এই সবকিছু বিবেচনায় মঙ্গল মানুষের আগ্রহের শীর্ষে অবস্থান করছে।
এবার বলা যাক, মঙ্গলে মানুষকে পাঠানোর ক্ষেত্রে কী কী বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রতি দুই বছর অন্তর পৃথিবী এবং মঙ্গল যখন সবচেয়ে কাছাকাছি আসে, তখন বর্তমানের কেমিক্যাল ফুয়েলের মাধ্যমে মঙ্গলে যেতে সময় লাগে সাত মাস। এখনই সাত মাস একটি ছোট স্পেস ক্রাফটে একসাথে থাকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। সাত মাসের সময়কালে তাদের জীবনযাপনে কোনো বৈচিত্র্য থাকবে না। সার্বক্ষণিক তারা একই দৃশ্য দেখবেন, একই ধরনের শব্দ শুনবেন এবং প্রায় একই ধরনের খাবার খাবেন। এটি তাদের মধ্যে একঘেয়েমি তৈরি করবে, যার ফলে বিভিন্ন ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সাথে ওজনহীনতার ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যাও তৈরি হবে।
এখন এই বিষয়গুলো কতটা প্রকট হতে পারে তা বোঝার জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (ISS) খুবই চমৎকার ভূমিকা পালন করছে। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে থাকা অ্যাস্ট্রোনটদের শারীরিক এবং মানসিক বিষয়গুলো কতটা পরিবর্তন হচ্ছে, তা থেকে দীর্ঘমেয়াদী স্পেস জার্নির ক্ষেত্রে অ্যাস্ট্রোনটদের মধ্যে কতটা মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তন আসবে তা বোঝা যায় বা স্টাডি করা যায়। এরপরেও নাসা এবং হাওয়াই ইউনিভার্সিটি সম্মিলিতভাবে হাওয়াইয়ের মরুভূমিতে আর্টিফিশিয়াল মার্সিয়ান পরিবেশ তৈরি করে তিনজন পুরুষ এবং তিনজন নারীকে ১২ মাস থাকার জন্য একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। তা থেকে অ্যাস্ট্রোনটদের মানসিক অবস্থায় কেমন পরিবর্তন আসবে তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।
স্পেস জার্নির ক্ষেত্রে অ্যাস্ট্রোনটদের শারীরিক এবং মানসিক বিষয়ের পরে সামনে আসে অ্যাস্ট্রোনট সহ একটি স্পেসক্রাফট মঙ্গলে ল্যান্ড করানো। এখন অ্যাস্ট্রোনটদের বহনকারী একটি পারফেক্ট ল্যান্ডার এখনো তৈরি করা হয়নি বা এমন ল্যান্ডার তৈরি করার জন্য আরও সময় প্রয়োজন। এরপর সামনে আসে অ্যাস্ট্রোনটদের মঙ্গলে থাকাকালীন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে প্রথমেই আসে থাকার স্থান। এর জন্য একটি চেম্বার তৈরি করতে হবে যেখানে বায়ুচাপ, অক্সিজেন সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়গুলো কীভাবে কাজ করবে তা নির্ধারণ করতে হবে।
এই ক্ষেত্রে অবশ্য অক্সিজেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মঙ্গলে সেই অক্সিজেন কোথা থেকে আসবে তা এখনো সমাধান করা যায়নি। যদিও পারসিভেরেন্স রোভার একটি প্রটোটাইপ মেশিন (মক্সি) দিয়ে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড ভেঙে অক্সিজেন তৈরি করা সম্ভব কিনা, তা যাচাই করা হচ্ছে। এরপর আসে অ্যাস্ট্রোনটদের খাবার। মঙ্গলের যে তাপমাত্রা, তাতে মঙ্গলে খোলা স্থানে চাষাবাদ অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের চিন্তা হলো মঙ্গলের মাটির নিচে চাষাবাদ করা কিংবা থাকার জন্য যে চেম্বার তৈরি করা হবে সেখানে চাষাবাদ করা। এটি কতটা সফল হবে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। যেমন, মঙ্গলের মাটিতে থাকা উপাদান দিয়ে আর্টিফিশিয়াল মঙ্গলের মাটি তৈরি করা হয়েছে। পরবর্তীতে কৃত্রিম আলোর মাধ্যমে সেই মাটিতে চাষাবাদের চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত টমেটো এবং গাজরসহ বেশ কিছু সবজির ক্ষেত্রে যথেষ্ট ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গিয়েছে।
খাবারের বিষয়ে পর আসে অ্যাস্ট্রোনটদের পৃথিবীতে ফিরে আসা। মঙ্গল পৃথিবী থেকে যথেষ্ট দূরে হওয়ার ফলে মঙ্গল থেকে ফিরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং মঙ্গলে পাঠানো মানুষদের ফিরে আসার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্বালানি কোথা থেকে আসবে, তা এখনো সমাধান হয়নি।
এই তো ছিল মেজর বিষয়গুলো। এছাড়াও অসংখ্য ছোটখাটো অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, যেগুলোর পারফেক্ট সমাধান বের করতে হবে। এর পরেই মঙ্গলে মানব মিশন পরিচালিত হবে। তবে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর ক্ষেত্রে যদি বিষয়টি এমনভাবে ভাবা হয় যে কোনো একজন মানুষ মঙ্গলে যাবার পর তাকে আর ফিরিয়ে আনা হবে না, সে ক্ষেত্রে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর বিষয়টি সহজ হয়ে আসবে। তবে এমন কাজ নৈতিকভাবে সঠিক হবে না। এমন চিন্তা বা কাজ মানুষের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করবে।
তারপরেও যে এমন চিন্তা করা হয়নি তা কিন্তু নয়। মঙ্গলে ওয়ানওয়ে মিশনের চিন্তাও করা হয়েছে। যেমন, মার্স ওয়ান হচ্ছে একটি প্রাইভেট ডাচ অর্গানাইজেশন, যারা ২০১২ সালে মঙ্গলে হিউম্যান কলোনি স্থাপনের বিষয়টি সামনে এনে টাকা সংগ্রহ শুরু করে। তাদের প্ল্যান ছিল অনেকটা এমন যে আগ্রহী মানুষের মধ্যে কয়েকজনকে বাছাই করে মঙ্গলে পাঠানো হবে এবং ওই মানুষগুলো তাদের পরবর্তী জীবন মঙ্গলের একটি কন্টেইনারে কাটিয়ে দেবে এবং সেখানেই মারা যাবে। অবশ্য তারা বাইরে বের হতে চাইলে স্পেসসুট ব্যবহার করে বের হতে পারবে। এইভাবে কয়েক ধাপে সেখানে মানুষ পাঠানো হবে, যার ফলে মঙ্গলে মানুষের একটি ছোটখাটো কলোনি তৈরি হবে।
এখন আপনি চিন্তা করুন, আপনাকে যদি বলা হতো, বাকি জীবন মঙ্গলে কাটাতে হবে এবং মঙ্গলেই মৃত্যুবরণ করতে হবে, তাহলে কি আপনি রাজি হতেন? হয়তো হ্যাঁ, হয়তোবা না। এখন আপনি যদি রাজি হয়ে থাকেন তবে জেনে রাখুন, আপনার মতো প্রায় ২০০,০০০ মানুষ এমন মিশনে যাবার জন্য আবেদন করেছিল। যাই হোক, ২০১২ সালে মার্স ওয়ান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০১৯ সালে এটি দেউলিয়া হয়ে যায়। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মঙ্গলে একদিন মানুষ যাবে এবং সে মানুষের প্রত্যেকটি পদক্ষেপই হবে ইতিহাস।
প্রত্যেক পদক্ষেপেই তারা হবেন প্রথম। প্রথম দিকে শুধুমাত্র টেলিস্কোপের মাধ্যমে মঙ্গলের পৃষ্ঠের স্ট্রাকচার দেখে মানুষ ধরে নিয়েছিল, সেগুলো মঙ্গলের প্রাণী বা এলিয়েনদের বসতবাড়ি। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মঙ্গলের এলিয়েন নিয়ে প্রচুর পরিমাণ সায়েন্স ফিকশন বই লেখা হয়েছে, অসংখ্য মুভি বানানো হয়েছে। এইসব বই এবং মুভি কিছু মানুষকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে, তা বোঝা যায় পরবর্তীতে তৈরি হওয়া কিছু কনস্পিরেসি থেকে।
যেমন, অনেকে বিশ্বাস করেন নাসা মঙ্গলের প্রাণী বা এলিয়েনের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই জেনেছে এবং এই বিষয়টি ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করে যাচ্ছে। তাদের দাবি হলো, নাসা ভবিষ্যতে মঙ্গলে মানুষ পাঠাতে চায় এবং এই জন্যই মঙ্গলের এলিয়েনের বিষয়টি গোপন রেখেছে। তাদের ধারণা হলো, মঙ্গলে প্রাণী থাকার বিষয়টি যদি মানুষ জেনে যায়, তবে কেউ মঙ্গলে যেতে রাজি হবে না। তাছাড়া মঙ্গলে প্রাণী থাকার পরেও সেখানে সশরীরে মানুষ পাঠানোর ক্ষেত্রে নৈতিক প্রশ্ন সামনে আসবে। যার ফলে এসব প্রতিবন্ধকতা এড়াতে নাসা মঙ্গলের এলিয়েনের বিষয়টি গোপন রেখেছে।
অনেকে খুব জোরালোভাবে দাবি করেন, কিউরিওসিটি রোভারের তোলা একটি ছবিতে একটি ইঁদুর রয়েছে। এই দাবি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে পরবর্তীতে নাসা এই বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছিল। নাসার কথা ছিল অনেকটা এমন যে, যেকোনো বড় স্থানের ইমেজে আপনি এমন অনেক কিছুই খুঁজে পেতে পারেন, যাকে দেখে কোনো একটি কিছুর মতো মনে হতে পারে বা সাদৃশ্য পাওয়া যেতে পারে। এই ছবির বিষয়টিও ঠিক তেমনই। আবার নিচের এই অংশকে অনেকে এলিয়েনের যাতায়াতের দরজা বলে আখ্যা দেন। অর্থাৎ এই অংশ দিয়ে এলিয়েন অন্য স্থান থেকে মঙ্গলে আসে আবার চলে যায়।
এখানে তো মাত্র দুইটি ইমেজের কথা বললাম। আরো বেশ কিছু ইমেজ নিয়ে বিভিন্ন উদ্ভট দাবি সামনে এসেছিল। বর্তমানে আমরা অন্য যে কোনো গ্রহের তুলনায় মঙ্গলকে খুবই বিস্তারিতভাবে জানি। যেমন, এর কোন স্থানে কী রয়েছে, তাপমাত্রা কেমন, বায়ুমণ্ডলীয় চাপ কেমন, রেডিয়েশন কেমন ইত্যাদি। মঙ্গলকে এতটা বিস্তারিতভাবে জানা সম্ভব হয়েছে মঙ্গলে পাঠানো অরবিটার, ল্যান্ডার এবং রোভারের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত মঙ্গল গ্রহে সবচেয়ে বেশি স্পেস মিশন পরিচালিত হয়েছে। মঙ্গল গ্রহে পরিচালিত সকল মিশন সম্পর্কে জানতে এই ভিডিওটি দেখতে পারেন। ভিডিও ভালো লাগলে বিজ্ঞানপ্রেমী পরিবারে যুক্ত হয়ে সাথে থাকতে পারেন।
Comments ২