চলুন জেনে নিই এক দিনে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ কৌশল মাত্র ১৩৬০ টাকায়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে পাহাড়, রেইন ফরেস্ট, হাওড় আর সবুজ চা বাগান ঘেরা যে উপজেলাটি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের অন্তর্গত, হাইল হাওরের পাশে অবস্থিত, তার নাম শ্রীমঙ্গল।
মাত্র তেরোশো ষাট টাকায় কিভাবে একদিনের একটি ট্রিপ সফলভাবে শেষ করা যায়, আজকে সেই বিষয়ে আপনাদের জানাবো। ধৈয্য নিয়ে পড়ুন তাহলে আপনি একদিনে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ প্লান করতে নিতে পারবেন।
শ্রীমঙ্গল এর ইতিহাস
প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী বলা হয় যে শ্রীদাস এবং মঙ্গলদাস নামে দুই ব্যক্তি প্রথমে এসে হাইল হাওরের তীরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাদের নাম থেকেই এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় শ্রীমঙ্গল। বন্ধুরা, বুঝতেই পারছেন আমাদের এবারের ভ্রমণ গন্তব্য চায়ের শহর শ্রীমঙ্গল।
বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী খ্যাত, দুটি করে একটি পাতার দেশ শ্রীমঙ্গলে আমরা কিভাবে গেলাম এবং একদিনে কি কি স্পট কভার করলাম, তারই বিস্তারিত বলবো। গত পর্বে আমরা সুন্দরবন করমজল ভ্রমণ একদিনে অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলাম।

আমাদের আজকের বরাবরের মতোই খরচ সংক্রান্ত বিস্তারিত থাকবে। আরো থাকবে কি কি করা উচিত এবং কি কি বর্জন করা উচিত, এরকম অনেক অনেক প্র্যাকটিক্যাল টিপস। সাথেই থাকুন পুরো পর্বে। তো চলুন শুরু করা যাক।
ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ
দশ জনের টিম মেম্বার নিয়ে আমরা এবারে যাত্রা শুরু করেছিলাম কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে। ট্রেন স্টেশনে গেলে সাধারণত ট্রেন পাওয়া যায়, তাই আমরা আগেই খোঁজ না নিয়ে স্টেশনে গিয়ে জানতে পারি যে সেদিন শ্রীমঙ্গলের বাকি ট্রেনগুলোর চলাচল বন্ধ ছিল।
তাই আমাদের বাধ্য হয়ে মেইল ট্রেনের টিকিট কাটতে হয়। সুরমা মেইল ট্রেনে জনপ্রতি টিকিট খরচ পড়েছিল ১১০ টাকা। তবে ভিন্ন মানের ট্রেনের টিকিট খরচ পড়বে ২৭৫ টাকার মতো।
এছাড়াও বাসে করে আপনারা শ্রীমঙ্গল যেতে পারবেন। আমাদের ট্রেন নয়টা ছাড়বার কথা থাকলেও প্রায় এক ঘণ্টা দেরি করে ছাড়ে রাত দশটা নাগাদ। এবারে যাত্রার শুরুতেই এমন এক ভোগান্তি হলো যে আপনাদের সাবধান করে দেওয়াটা জরুরি মনে করছি।
যাতে আপনারা এই ট্রেনগুলোতে না যান, আর সাথে যদি শিশু বা মহিলা থাকে তাহলে তো আরো না। আর এসব ট্রেনের কোনো সিট নির্দিষ্ট থাকে না। টিকিট কেটে উঠলেও একরকম মারামারি হুড়হুড়ি করে আমাদের সিট নিতে হয়েছিল।
মেজাজটা একটু খারাপ থাকলেও বন্ধুদের সাথে গান-বাজনা করে পরিবেশটা একটু হালকা করে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। “বসে বসে রং মাখে না, তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা? মন জানো না, তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা…”
এভাবে বেশ খানিকটা যাবার পর রাত আড়াইটা নাগাদ ভৈরব স্টেশনে ট্রেন একটু বেশি সময়ের জন্য থামল। তাই আমরা নেমে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। কেউ কেউ চা, বিস্কুট, চিপস এগুলো খেয়ে আবার ট্রেনে উঠে পড়ল।
ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। আমরাও কিছুক্ষণ গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়ল ভোর হয়ে গেছে। যদি এমন সুন্দর দৃশ্যের মধ্য দিয়ে দিন শুরু হয়, তবে বলা যায় বাকি সময়টা একেবারে দুর্দান্ত কাটবে। তাই রাতের খারাপ অভিজ্ঞতা ভুলে আমরা এরকম সবুজ দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ উপভোগ করতে করতে ট্রেন থামার অপেক্ষা করছিলাম।
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে সিলেট জেলার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বিশ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত শ্রীমঙ্গল উপজেলা, যা চারশো পঁচিশ দশমিক পনেরো বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। সকাল দশটা নাগাদ আমাদের শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হল।
আরও পড়ুনঃ কন্যাকুমারী – তিন সাগরের মোহনায় দেখা মেলে তিন রঙের জলের ধারা
শ্রীমঙ্গল শহর ঘুরে দেখা
ব্যাগ নিয়ে সবাই নেমে পড়লাম শীতে কুঁকড়ে হয়ে। সবার আগে আমাদের একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। এখান থেকে শহর ঘুরে দেখার জন্য আপনি সিএনজি, অটো এবং লাল রঙের জিভ পেয়ে যাবেন। সদস্য সংখ্যা বুঝে এবং নিজেদের চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী আপনারা দরদাম করে এখান থেকে বাহন নিয়ে যাবেন।
আমরা যেহেতু দশজন ছিলাম, তাই আমরা একটা জিপ গাড়ি নিয়ে নিই। ২৮০০ থেকে ৩৫০০ টাকার মধ্যে এখানে জিপ গাড়ি ভাড়া পেয়ে যাবেন। তবে অবশ্যই আপনাকে দরদামের পুটু হতে হবে।

সকালের নাস্তা
গাড়ি ভাড়া শেষ করে আমরা এবার সবার প্রথমে সকালের নাস্তা সেরে নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। স্টেশনের পাশেই কিছুদূর পরে ছিল লন্ডন রেস্টুরেন্ট।
আমরা সেখানে গিয়ে চিকেন খিচুড়ি অর্ডার করলাম। খিচুড়ির সাথে একটা ডিমও ছিল। নব্বই টাকার নাস্তাটা বেশ ভরপেট হয়েছিল এবং খাবারের টেস্টও ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু।
ভ্রমণ প্রস্তুতি
খাবার খেয়ে আমরা আমাদের আজকের ভ্রমণ শুরু করার জন্য প্রিপারেশন নিলাম। এখানে একটু বলে রাখি, আমরা আজকে প্রথমে যাব বাইক্কা বিল। শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের পূর্ব দিকের প্রায় ১০০ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমির নাম বাইক কাবিল, যা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
সেখান থেকে আমাদের যাত্রার তালিকা রয়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, নুরজাহান টি.এস.টি.ই.ডি. এবং নীলকণ্ঠ চা কেবিন প্রকৃতি। তো চলুন দেখা যাক আমরা কি কি, কতক্ষণে কতটুকু কভার করতে পারি।
বাইক্কা বিল যাত্রা
এগারোটা বিশের দিকে আমরা লাল চিপে করে মহা উৎসাহে রওনা করি বাইক্কা বিলের দিকে। তখনো সূর্য তেমন একটা তাপ ছড়ায়নি। যেহেতু শীতকাল, তাই আশেপাশে বেশ কুয়াশা আর ঠান্ডা ছিল। এরই মধ্যে আমরা জীপে খুব উপভোগ করতে করতে আনন্দ করতে করতে বিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
পথের সৌন্দর্য আপনারা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছেন। দু’পাশের পানির মাঝখান দিয়ে যে আঁকাবাঁকা পথটি চলে যাচ্ছিল, তা আমাদের নিয়ে পৌঁছালো বাইক্কা বিলে গেট অবধি।
বাইক্কা বিল
১ জুলাই ২০০৩ তারিখে বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয় এই বিলটিকে মৎস্য সম্পদের একটি অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। আইন কোয়েল, মেনি ফলি, প্রাপ্তাসহ আরো অনেক প্রজাতির মাছ এখানে বংশবৃদ্ধি করে পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে।

এই বিল মাছের জন্যই শুধু নয়, পাখি এবং অন্যান্য অনেক প্রাণীর জন্যেও একটি চমৎকার নিরাপদ আবাসস্থল। এটি একটি নয়নাভিরাম জলাভূমি, যেখানে হাজারো শাপলা আর পদ্মফুল ফোটে।
এছাড়া এই বিলের বুনো বাসিন্দা এবং শীতে আগত অতিথি পাখিদের ভালোভাবে দেখার জন্য তৈরি হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বা ওয়াচ টাওয়ার।
সেই টাওয়ারে ওঠার আগে আপনাকে এমন সবুজ জঙ্গলে ঘেরা একটা পথ পাড়ি দিতে হবে। ক্ষণিকের জন্য মনে হতে পারে আপনি হয়তো বাংলাদেশে নয়, বরং অন্য কোনো জায়গায় চলে এসেছেন।
পাখির কিচিরমিচির যেন আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। আপনি যদি পাখি প্রেমিক হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই এই সময়ে আপনার উচিত একবার বাইক্কা বিল ঘুরে যাওয়া।
প্রকৃতি প্রেমের চোখে পাখি এই অভয়াশ্রমের সেরা প্রাণী। শীত মৌসূমে এখানে আসে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। এই বিলের উল্লেখযোগ্য পাখিদের মধ্যে রয়েছে পানকৌরি, রাঙ্গাবক, শঙ্খচিল, কানেবক, ধলাবক, গোবক, ধুকলিবক, দলপিপি, নেউপিপি, পানমুরগি, বেগুনি কালেম, কালোমাথা কাঁচকোড়া এবং পালাসেডকুড়া ইত্যাদি। শীতের অতিথি হয়ে এই বিলে আসে অনেক জাতের সৈকত পাখি।
এদের মধ্যে গেওয়াওয়ালা, বাটান, মেটে, মাথা চিটি আর কালাপঙ্ক, ঠ্যাংকি, ধলা, বালি, হাঁস, পাতিসরালি, রাত সরালি, মরণ চেয়ারম, ভুতিহাস, গিরিহাস, লেংগাহাশ, গুটিয়েগোল, উল্লেখযোগ্য।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে দূরে আপনি দেখতে পাবেন নাম না জানা অসংখ্য পাখি। নিচে নৌকা বাথা দেখলাম, কিন্তু মাঝির দেখা মিললো না। হয়তো এখানে নৌকা নিয়ে ঘুরে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু আমাদের চোখে তেমন কিছু পড়লো না। আরো খানিকটা সময় সেখানে কাটিয়ে আমরা নেমে পড়লাম ওয়াচ টাওয়ার থেকে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। তাই আমরা আবারও জীপে উঠে একই পথে আবার রওনা করলাম।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান যাত্রা
লাউয়াছড়ার দিকে সবুজে ঘেরা হালকা হলদে রোদের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে চলতে থাকলো আমাদের জীপগাড়ি। গ্রামীণ চিরচেনা বাংলার রূপ আপনি এখানে মন প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারবেন। একটু পরেই দেখতে পারবেন আশেপাশে চা বাগানের টিলা আর পাহাড়।
পুরো শ্রীমঙ্গল জুড়েই এই দৃশ্যের দেখা মিলবে, কিন্তু আপনার ক্লান্ত লাগবে না একটুও। ০১:২০ মিনিটে আমরা হাজির হলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গেইটে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান উপভোগ
বাংলাদেশের বিখ্যাত বনগুলোর মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। পরিচিতির দিক থেকে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়ার অবস্থান।
বাংলাদেশের সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং দশটি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে এটি অন্যতম। গেইটের কাছে গাড়ি থেকে নামার পর দেখলাম এখানে গাড়ি পার্কিং করার সুব্যবস্থা রয়েছে। জনপ্রতি ১১৫ টাকা করে টিকেট কেটে আপনাকে এই উদ্যানের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে।
ছোট বাচ্চাদের টিকিটের দাম আরো কম পড়বে। তবে এখানে বানরের উপদ্রব খুবই বেশি, তাই এখানে আপনাকে সাবধান থাকতে হবে। যদি বাচ্চা থাকে, তাহলে খুব সাবধানে রাখতে হবে।
হাতে থাকা খাবার, মোবাইল ইত্যাদি দেখলে ওরা গাছ থেকে নেমে এসে থাবা দেয়, তাই প্রয়োজনে জরুরি জিনিসপত্র সাবধানে রাখতে হবে।
এই উদ্যানে প্রবেশের জন্য অনেকেই গাইড নিয়ে থাকে। আমরা কোনো গাইড নিইনি, কিন্তু আপনারা যদি চান এবং হাতে যদি সময় থাকে, তাহলে গেইট থেকে ঢোকার সময় লোকাল গাইড ভাড়া করে নিতে পারবেন। উদ্যানের ভেতরে রয়েছে খাসিয়া পল্লী।
সেটা বিস্তারিত জানতে হলে বা ঘুরে দেখতে হলে সাথে একজন গাইড রাখা ভালো। কিন্তু আমাদের সময় স্বল্পতার কারণে আমরা খাসিয়া পল্লীতে যেতে পারলাম না। উদ্যানের প্রবেশের পর নাম না জানা অসংখ্য গাছের মধ্য দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম ভেতরের দিকে।
এই উদ্যানের ভেতরে রয়েছে একটা প্রসিদ্ধ রেললাইন। পর্যটকরা এখানে আসলে অবশ্যই এই রেললাইনের সাথে কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করে নিয়ে যান। কারণ এই বিখ্যাত রেললাইনে কিন্তু হলিউড মুভি Around the World in 80 Days এবং ঢালিউড সিনেমা আমার আছে জল শুটিং হয়েছিল।
আমরাও হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পরে পৌঁছে গেলাম বহুল প্রতীক্ষিত সেই রেললাইনের কাছে। ভাগ্যক্রমে আমরা এখানে ট্রেনের দেখা পেয়ে গেলাম, তাই সেই মুহূর্তটুকু ক্যামেরাবন্দি করতে ভুল হলো না। আমরা এখানে অনেকটা সময় পার করে আস্তে আস্তে বের হবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আয়তনে ছোট হলেও এই বন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বনের মধ্য দিয়ে হাঁটলে নানা ধরনের বন্য প্রাণী, পাখি এবং কীটপতঙ্গের শব্দ শোনা যায়, যা আপনাকে দেবে এক অদ্ভুত অনুভূতি।
বনের মধ্য দিয়ে প্রায় সারাক্ষণই সাইরেনের মতো শব্দ হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এটি এক ধরনের জিজি পোকার শব্দ। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণী রয়েছে, এর মধ্যে ১৬৭টি প্রজাতির উদ্ভিদ. ৪ প্রজাতির উপচর, ৬ প্রজাতির সরিসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়।
জিজির শব্দ শুনতে শুনতে আমরা বন থেকে বের হয়ে ঝটপট গাড়িতে উঠে পড়লাম। এবার আমরা যাব মাধবপুর লেকে। আগের মতোই পাহাড়ি চা বাগানের মাঝ দিয়ে চলতে শুরু করল আমাদের জিপ গাড়ি।
মাধবপুর লেক
ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি, বাইক, জিপে চড়ে খুব সহজেই ভানুগাছ চৌমোহনা হয়ে পৌঁছে যাবেন এই কৃত্রিম লেকে। জিপ গাড়ি পার করার জন্য ৫০ টাকা দিয়ে আমাদের নিতে হলো একটি টিকেট। আপনারাও পার্কিং ফি পরিশোধ করে একটা টিকিট নিয়ে নেবেন, তাহলে গাড়ি পার্কিং নিয়ে আর ভাবতে হবে না।
নিশ্চিন্ত মনে সময় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন অসংখ্য পাহাড় ও টিলা দিয়ে ঘেরা ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই লেকটি। ঢোকার আগেই গেইটের কাছে আমরা পেয়ে গেলাম এক আনারস বিক্রেতার দেখা। শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি আনারসের সুনাম আপনারা শুনে থাকবেন।
এগুলো আকারে ছোট, কিন্তু খেতে অত্যন্ত সুমিষ্ট হয়। আমরা এখান থেকে আনারস মাখা কিনে নিয়ে খেতে খেতে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কাঁচা মাটির রাস্তা, কিছুটা ভেজা ভেজা অবস্থায় আমরা পৌঁছে গেলাম লেকের পাশেই।
আর সেখানে পৌঁছাতেই আমাদের চোখে নয়নাভিরাম দৃশ্যের খেলা চলল। যদিও শীতকালে লেকের আসল সৌন্দর্য কিছুটা কম হয় বলে স্থানীয়রা বলেন, কিন্তু হিমশীতল পরিবেশ আর মিষ্টি রোদের হাতছানিতে আমাদের এই দুপুরবেলাটাও খারাপ লাগছিল না।

এই লেকে নীল পদ্মফুলের দেখা মিলবে, তাই পর্যটকরা এই নীল পদ্মের সাথে এখানে ছবি তুলতেও বেশ পছন্দ করেন। আর সকাল সকাল এলে কিন্তু অতিথি পাখিদেরও দেখা মিলবে। এবার আমরা উঠে পড়লাম লেকের গা ঘেঁষে থাকা টিলার উপরে।
টিলার উপর থেকে লেকটার পুরো ভিউ পাওয়া যায়, তাই এখানে আসলে অবশ্যই টিলার উপরে উঠে প্রকৃতির পরম সৌন্দর্য মন ভরে উপভোগ করে নেবেন। এখানে না আসলে বোঝাই যায় না যে টিলাটাকে ঘিরে এভাবে পানি জমিয়ে এরকম একটা কৃত্রিম লেক তৈরি করা সম্ভব।
মূলত ১৯৬৫ সালে টিলা কেটে বাদ দিয়ে এই লেকটা তৈরি করা হয়েছিল। এই লেকটা পুরোটা হেঁটে দেখা সম্ভব, নিচে আপনি মানুষের হাঁটার রাস্তা পেয়ে যাবেন। তবে আমাদের সময় স্বল্পতার জন্য আমরা আর পুরোটা হেঁটে দেখলাম না।
উপরেই আমরা অনেকটা সময় কাটিয়ে ছবি তুলে, আড্ডা দিয়ে প্রকৃতির সাথে আমাদের সময়টা কাটালাম। এরপর আমাদের যেতে হবে নূরজাহান টি এস্টেটে, তাই আমরা নেমে পড়ি টিলা থেকে।
টিলা থেকে নেমে আমরা আবার শসা, আনারসের দোকান দেখতে পেলাম। এছাড়া ডাবের দোকানও রয়েছে, যা আপনারা কিনে নিতে পারেন। আর আমরা আরেকটা মজার জিনিস খেয়েছিলাম, সেটা হলো স্থানীয় চাকমারা তৈরি করা এক ধরনের চা পাতার ভর্তা।
এটার বিশেষ আলাদা কোনো নাম নেই, এটাকে চা পাতার ভর্তাই বলে। খেতে বেশ ঝাল আর অন্যরকম স্বাদ হয়, যা আমি আগে কখনো এক্সপেরিয়েন্স করিনি। যেহেতু শীতের সময় সূর্য অস্ত যায় তাড়াতাড়ি, তাই আমাদের সময় কম থাকায় আমরা জলদি রওনা দিয়ে দিলাম টি এস্টেটের উদ্দেশ্যে।
নূরজাহান টি এস্টেট
জিপে উঠে আমরা রওনা দিলাম নূরজাহান টি এস্টেটের দিকে। সূর্য ততক্ষণে প্রায় অস্তাচলে, তাই আমরা সূর্যাস্তটা মিস করতে চাই না। আবীর মাখা নীল আকাশ আর সবুজের মাঝ দিয়ে আমরা ছুটে চললাম আমাদের পরবর্তী টি এস্টেটে।
পাহাড় কাটা রাস্তা পেরিয়ে আমরা যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম চা বাগানে। আলো বেশ কমে এসেছে, তাই ক্যামেরায় হয়তো প্রকৃত সৌন্দর্য ধরা দেয়নি। তবে আমরা আমাদের মতো করে এই জায়গাটা বেশ ভালোভাবে উপভোগ করলাম।
যদিও তখন মাত্র সাড়ে চারটা বাজে, তবে ওই যে, পাহাড়ের সূর্য যে একটু জলদি লুকিয়ে পড়ে! এই চা বাগানের সৌন্দর্য অন্য যে কোনো টি এস্টেটের থেকে আলাদা।
তাই পর্যটকদের কাছে এই চা বাগানটা মিস না করার মতোই একটা জায়গা। এখানে না আসলে সত্যিই মিস হয়ে যেত। তাই আপনারা আপনাদের ট্রাভেল প্ল্যানিংয়ের সময় অবশ্যই এই টি এস্টেটটাকে তালিকায় রাখবেন।
প্রতিটা পাহাড় আর চা গাছ যেন ধুয়ে-মুছে পরম যত্নে লালিত। একদম সমান মাপে কেটে রাখা প্রতিটা গাছ মায়াবী এই সবুজ আঙিনার সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এবার আমাদের বিদায় নেবার পালা, কারণ সূর্য প্রায় অস্তমিত।
নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা আলো থাকতে থাকতে শহরে ফিরে যাওয়াই সুবিধাজনক মনে করলাম। তাই আমরা আমাদের আজকের শেষ স্পটের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠে পড়ি।
নীলকণ্ঠ টি কেবিন
এবার আমরা যাব নীলকণ্ঠ টি কেবিনে। বৈকালিক নাস্তা আর চায়ের আড্ডাটা সেখানেই শেষ করব ভেবে আমরা পৌঁছে গেলাম বিখ্যাত এই চা কেবিনে।
এখানে রমেশ রামগৌর উদ্ভাবিত সাত লেয়ারের চা পাওয়া যায়, এটা তো আপনারা অনেকেই জানেন। সেখানে গিয়ে আমরা নানা রকমের চায়ের দরদাম লেখা লিস্টটি দেখতে পাই। যেহেতু সাত স্তরের চায়ের জন্য এই দোকানটি খুবই বিখ্যাত এবং প্রসিদ্ধ, তাই আমরাও সাত লেয়ারের চা অর্ডার করে ফেললাম।
লম্বা একটা সময় চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হলো, তবে আমাদের কাছে চায়ের স্বাদ খুব একটা ভালো লাগেনি। তাই আমরা পরে আবার রংচা নিলাম। সারাদিনের পরিশ্রমের পর এখানে বেশ সময় নিয়ে আড্ডা দিয়ে চা পান করলাম এবং বিশ্রাম নিলাম।
এটাই আমাদের শেষ স্পট, তাই আমাদের আর কোনো তাড়া ছিল না। আমরা সময় নিয়ে চা শেষ করলাম। এরপর পাশে থাকা চায়ের দোকানে গেলাম চা পাতা কিনতে। শ্রীমঙ্গলে এসে তো আর চা পাতা না কিনে ঢাকায় ফেরা যায় না!
প্রয়োজনীয় কেনা কাটা
তাই যে যার পরিবারের জন্য ও নিজের পছন্দমতো বাজেট অনুযায়ী চা পাতা কিনে নিল। এখানে অনেক রকমের চা বিক্রি হয়।
বিক্রয়কর্মীদের সহায়তায় আপনি আপনার পছন্দের চা পাতা কিনে নিতে পারবেন। এই চা পাতার স্বাদ আমাদের শহরে বিক্রি হওয়া চা পাতার তুলনায় বেশ ভালো।
রাতের খাবার
স্টেশনের পাশেই টি ভ্যালি নামের হোটেলে আমরা রাতের খাবারের জন্য ঢুকে পড়লাম। আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন, আমরা দুপুরের খাবারের জন্য কোথাও থামিনি। সময় কম থাকায় খাবারের পেছনে সময় ব্যয় করতে চাইনি।
তাই এই সময়ে আমরা দুপুর আর রাতের খাবার একসাথে খাব বলে এই হোটেলে ঢুকে পড়লাম। জনপ্রতি মাত্র ১৪০ টাকায় নিলাম ভাত, ডাল, মুরগির মাংস ও ভর্তাবাজি।
এবার বিদায়ের পালা। ১০ টাকা অটো ভাড়া করে আমরা চলে গেলাম বাস স্টেশনে। রাত বারোটার টিকিট পেয়ে গেলাম শ্যামলী বাসে।
খরচের ওভারভিউ
যাবার আগে একবার খরচের হিসাব দিয়ে দিচ্ছি আপনাদের জন্য। পুরো ট্রিপে কোথায় কেমন খরচ হলো একসাথে দেখে নিন।
আমাদের জিপ ভাড়া পড়েছিল ২৮০০ টাকা, যা জনপ্রতি ২৮০ টাকা করে। সকালে নাস্তায় খরচ হয়েছিল ৯০ টাকা। লাউয়াছড়া প্রবেশের টিকিট ফি ছিল ১১৫ টাকা। অন্যান্য টিকিট খরচ ধরলাম ২৫ টাকা। দুপুরের খাবার ১৪০ টাকা এবং রাতে বাসের ফেরার টিকিট ছিল ৫৫০ টাকা।
সব মিলিয়ে এই ট্রিপে আমার খরচ হলো ১৩৬০ টাকা। আর এরই সাথে শেষ হলো একদিনের আমাদের শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ।
Comments ৩