একটি আংশিক সত্য গল্প বলে ভিডিও শুরু করছি। কিছুদিন আগে সাব্বিরের সাথে আমার দেখা। তখন কথাবার্তার এক ফাঁকে সাব্বির আমাকে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা বল তো, সূর্য থেকে যে আলো এখন আমাদের শরীরে পড়ছে, তা কতক্ষণ আগে উৎপন্ন হয়েছে?”
আমি তখন তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, “এত সহজ একটি প্রশ্ন করলেন! সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে গড়ে সময় লাগে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। সুতরাং, সূর্য থেকে যে আলো আমাদের শরীরে এই মুহূর্তে এসে পড়েছে, তা ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগে সূর্যে উৎপন্ন হয়েছে।” তখন সাব্বির প্রতি উত্তরে বললো, “এই হলো তোমার ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা!”
আমি কিছুটা বিব্রত হয়ে ভাবতে লাগলাম, সাব্বির এমন হাসির কারণ কী। মনে করুন, আপনার হাতে একটি লাইট বাল্বের সুইচের মতোই একটি সুইচ রয়েছে, যা দিয়ে সূর্যকে অন-অফ করা যাবে। যদিও এটা সম্ভব নয়, তবু কল্পনা করুন।
এখন সুইচটা অফ করে দিলে কী ঘটবে? সাথে সাথে সূর্য নিভে যাবার কথা। কিন্তু না, আমরা সূর্য নিভে যেতে দেখব সুইচ অফ করার ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড পর।
সূর্য থেকে গড়ে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে পৃথিবী অবস্থান করে। এই দূরত্ব কখনো কিছুটা বেশি হয়, আবার কখনো কিছুটা কম। কারণ পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে উপবৃত্তাকার পথে। আলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী বস্তু, যার গতি সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বকে আলোর এই গতিতে ভাগ করলে পাওয়া যায় ৫০০ সেকেন্ড, যা প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড।
এটাই হচ্ছে গড় সময়, যা সূর্য থেকে আলো অর্থাৎ ফোটন পৃথিবীতে আসতে লাগে।
সূর্য নিভে গেছে, এটি জানতে আমাদের তাই ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় লাগবে।
কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, যে সূর্যের আলো ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ডে পৃথিবীতে আসে, তা কিন্তু সূর্যের ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগে উৎপন্ন হয়নি।
এটি উৎপন্ন হয়েছে ধারণার চেয়েও অনেক, অনেক বেশি সময় আগে।
অর্থাৎ, সূর্যের আলো আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি পুরোনো।
ওয়েট!
সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে মাত্র ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় লাগে।
তাহলে সূর্যের কেন্দ্রে আলো উৎপন্ন হবার পর ১ সেকেন্ড সময়ও লাগার কথা নয় সূর্য থেকে বের হয়ে স্পেসে আসতে।
তাহলে কেন সূর্যের আলোকে ধারণার চেয়ে অনেক বেশি পুরোনো বলা হচ্ছে?
আলো অর্থাৎ ফোটন সরলরেখায় সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসে, যার ফলে আমরা ছায়া দেখতে পাই।
কিন্তু সূর্যের ভেতরে ফোটনের গতিপথ সরলরৈখিক নয়।
ফোটন হচ্ছে সূর্যের কেন্দ্রে সংঘটিত পরমাণু সংযোজন (নিউক্লিয়ার ফিউশন) বিক্রিয়ার বাই-প্রোডাক্ট।
দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু একসঙ্গে মিলে হিলিয়ামে পরিণত হয়।
সূর্যের কেন্দ্র বলতে গেলে এক বিশাল হাইড্রোজেন বোমার সমারোহ, যেখানে প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটে।
এই বিস্ফোরণের ফলে সূর্যের কেন্দ্র প্রসারিত হতে চায়।
তখন আবার মাধ্যাকর্ষণের কারণে তা সংকুচিত হয়ে যায়।
সূর্যের ভেতরে সংঘটিত এই পুশ এবং পুল সূর্যের আলোকে বাইরে আসতে কঠিন করে তোলে।
সূর্যের কেন্দ্রে সংঘটিত প্রতিটি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণ শক্তি নিঃসৃত হয় গামা রশ্মি আকারে।
গামা রশ্মি হচ্ছে সবচেয়ে উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন ফোটন।
গামা রশ্মি উৎপন্ন হবার পর সূর্যের অভ্যন্তরে থাকা অন্য কণার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং দিক পরিবর্তন করে।
এভাবে বারবার সংঘর্ষের ফলে গামা রশ্মি ধীরে ধীরে শক্তি হারাতে থাকে।
প্রথমে এটি এক্স-রে, তারপর আলট্রাভায়োলেট রশ্মি এবং শেষে ভিজুয়াল লাইটে রূপান্তরিত হয়।
সূর্যের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার পর ফোটন, অর্থাৎ গামা রশ্মি উৎপন্ন হবার পর বিভিন্ন কণার সাথে সংঘর্ষের ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ র্যান্ডম।
কোনো সমীকরণ দিয়েই এর গতিপথ নির্ধারণ করা যায় না।
গামা রশ্মির এই র্যান্ডম গতিপথকে বলা হয় “র্যান্ডম ওয়াক।”
আলো অর্থাৎ ফোটনের এই র্যান্ডম ওয়াক কতক্ষণ স্থায়ী হয়?
বিজ্ঞানীরা সূর্যের অভ্যন্তরের ঘনত্ব ও অন্যান্য বিষয় মাথায় রেখে জটিল হিসেব করে দেখেছেন,
সূর্যের কেন্দ্রে গামা রশ্মি উৎপন্ন হবার পর প্রায় ১,৭০০,০০০ বছর র্যান্ডম ওয়াক করে।
এরপর এটি ভিজুয়াল লাইটে রূপান্তরিত হয়ে সূর্য থেকে বের হয়।
এই র্যান্ডম ওয়াক আমাদের মহাবিশ্বের অনেক কিছুতেই রয়েছে।
যেমন তরল বা গ্যাসের প্রসারণ, ব্যাকটেরিয়া বা বিভিন্ন প্রাণীর চলাচল।
তাছাড়া, যে কোনো গন্ধও কিন্তু এই র্যান্ডম ওয়াকের মাধ্যমেই আমাদের নাক পর্যন্ত এসে পৌঁছে।
স্মেল মলিকিউল বাতাসের কণার সাথে ধাক্কা লেগে লেগে একসময় আমাদের নাকে এসে গন্ধের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
স্মেল মলিকিউলের এই র্যান্ডম ওয়াককে বলা হয় “ব্রাউনিয়ান মোশন”।
এখন একটি অদ্ভুত বিষয় বলা যাক।
সূর্যের আলো উৎপন্ন হবার পর ১,৭০০,০০০ বছর র্যান্ডম ওয়াকের পর আমাদের কাছে এসে পৌঁছে।
কিন্তু আমরা যদি আলো অর্থাৎ ফোটনের দিক থেকে বিষয়টি লক্ষ্য করি,
তবে ফোটনের মনে হবে যে সে উৎপন্ন হবার পরপরই পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে।
কারণ ফোটন আলোর গতিতে চলে।
আর কোনো বস্তু যদি আলোর গতিতে চলে, তখন তার জন্য সময় স্থির হয়ে যায়।
বিষয়টি অদ্ভুত মনে হতে পারে, তবে বিষয়টি কিন্তু বাস্তব।
সুতরাং সূর্যের আলো একদিকের বিবেচনায় অনেক বয়স্ক,
আবার অন্যদিকের বিবেচনায় সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু।
তাহলে এখন যদি বলা হয় যে সূর্যের আলো, যা আমাদের শরীরে এই মুহূর্তে এসে পড়ছে, তা কত আগে উৎপন্ন হয়েছে—
এটির উত্তর দুই রকম।
আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটি ১,৭০০,০০০ বছর আগে।
আর ফোটনের বিবেচনায় সেটি ০ সেকেন্ড।
যাক, শেষ পর্যন্ত সাব্বিরের হাসির কারণ কিছুটা হলেও জানা গেল।
পারমাণবিক বোমা বা অ্যাটম বোমা কীভাবে কাজ করে, অর্থাৎ বোমার ভেতরের কার্যপ্রক্রিয়াটি কেমন, তা জানতে এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।
সেই সাথে, ভিডিওটি ভালো লাগলে “বিজ্ঞান পাইসি” চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখতে পারেন।
Comments ১