সেকেন্ড নির্ণয় ইতিহাস: টিক, টিক, টিক। ঘড়ির এমন প্রত্যেকটি টিক মানে ১ সেকেন্ড করে সময় অতিবাহিত হওয়া। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, আপনি কি নিশ্চিত প্রত্যেকটি টিক ঠিক ১ সেকেন্ড পরপরই হচ্ছে? যদি আপনি নিশ্চিত হন যে প্রতি দুইটি টিকের মধ্যবর্তী সময় ১ সেকেন্ড, তবে সেটা আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন? আর কিভাবেই বা এমন নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব যে একটি যন্ত্র প্রত্যেকবার ঠিক একই সময়ের ব্যবধান প্রদর্শন করবে?
এ সকল প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে মানুষ কিভাবে সময় গণনা শুরু করেছিল এবং বর্তমানে কিভাবে সময় গণনা করা হয়। বর্তমান সময়ে অতি সূক্ষ্মভাবে সময় গণনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ প্রথমত প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর সকল মানুষ পরস্পরের সাথে কানেক্টেড, যার ফলে সবার সময় গণনা ১ এবং অবিন্য হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে পরিমাপের অন্য সকল মৌলিক একক সমূহ সেকেন্ডের ওপর নির্ভরশীল, যার ফলে সেকেন্ডের সংজ্ঞা কিংবা ১ সেকেন্ড আসলে যতটুকু সময় তা থেকে একটু এদিক সেদিক হওয়া মানেই অন্য সবকিছুকে প্রভাবিত করা, যার ফলে সেকেন্ডের অতি সূক্ষ্ম পরিমাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সেকেন্ড নির্ণয় ইতিহাস
আজকের ভিডিওতে এই সেকেন্ড সম্পর্কে বলা হবে। আমি জুম্মান আছি, আপনাদের সাথে, আপনারা দেখছেন বিজ্ঞান পাইছি।
মনে করুন, পৃথিবীতে কোন প্রকার ঘড়ি নেই। এখন এমন একটি পৃথিবীতে আচমকা রাতে আপনার ঘুম ভেঙে গেলে, আপনি কিভাবে বুঝবেন যে তখন রাত কয়টা বাজে কিংবা কতটুকু রাত অতিক্রম হয়েছে, কিংবা ভোর হতে আর কতটুকু সময় বাকি?
কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন, তাইতো? ঠিক এই একই সমস্যায় পড়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা। প্রথম থেকে শুধুমাত্র ঋতুর পরিবর্তন বোঝার জন্য সময় গণনা শুরু হয়েছিল, কারণ ঋতুর পরিবর্তন হওয়া মানে আবহাওয়ার পরিবর্তন। যেমন গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত।
আরও পড়ুনঃ শব্দ সমাচার What is sound, Sound wave properties and Anechoic room
আবার এই ঋতুর সাথে ফসলের বিষয় সম্পৃক্ত, যার ফলে কতটা সময় পরপর ঋতুর পরিবর্তন হয় তা গণনার প্রয়োজন ছিল। সময় গণনার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায় লাসোকেইভে থাকা পেইন্টিংয়ে। প্রায় ১৭০০০ বছর আগের ক্রোম্যাগনন মানুষের আঁকা এই পেইন্টিংগুলোতে প্রাণীর ছবির পাশাপাশি সুবিন্যস্ত কিছু ডট দেখা যায়।
ধারণা করা হয়, এই ডটগুলোর মাধ্যমে সেই সময়ের মানুষেরা চাঁদের বিভিন্ন সময়ের অবস্থা বা ফেইস চিহ্নিত করে রাখত, যেমন পূর্ণ চাঁদ, অর্ধপূর্ণ চাঁদ ইত্যাদি, যার মাধ্যমে পরবর্তী ঋতু আসতে আর কতটা সময় বাকি রয়েছে তা বোঝা যেত।
পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে সময়কে আরো ছোট অংশে গণনার প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে। দিনের দৈর্ঘ্যকে বারোটি অংশে ভাগ করে গণনা শুরু করে প্রাচীন মিশরীয়রা এবং সেটা তারা করেছিল সূর্যের মাধ্যমে। কোন একটি বস্তুকে সূর্যের আলোতে রাখলে, ওই বস্তু থেকে ছায়া তৈরি হয়।
এখন আকাশে সূর্য যেহেতু ১ স্থানীয় স্থির থাকেনা, সেও তো ছায়াও স্থির থাকে না। ছায়ার এই পরিবর্তনকে বিভিন্ন কৌশলে পরিমাপ করে মিশরীয়রা তৈরি করে সূর্যঘড়ি বা সানডাইন এর মাধ্যমে দিনের বেলা কতটুকু সময় অতিবাহিত হয়েছে তা গণনা শুরু হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে রাতের সময় গণনা সম্ভব নয়, কারণ রাতের বেলায় সূর্য থাকে না।
এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবন হয়, যেমন একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে পাশে কিছু দাগ টেনে দিলে কতটুকু মোম পড়ল তা থেকে সময়ের আইডিয়া পাওয়া যায়। আবার একটি ছিদ্রযুক্ত পাত্রে পানি নিয়ে পাত্রের গায়ে দাগ টেনে দিলে, কতটুকু পানি ছিদ্র দিয়ে পড়ল তা থেকে সময়ের আইডিয়া পাওয়া যায়।
সময় গণনার এই সকল পদ্ধতি ওই সময় পর্যন্ত উপযুক্ত ছিল, যে সময় পর্যন্ত শিল্পায়ন শুরু হয়নি। শিল্পায়নের পর সময়ের আরো সঠিক গণনার প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে, কারণ তখন সময় হিসেবে কাজ শুরু হয়, যার ফলে সময়কে আরো ছোট অংশে ভাগ করে গণনার দরকার সামনে আসে।
আরও জানুনঃ সেকেন্ড নির্ণয় ইতিহাস Time keeping history and Second definition
যদিও ইতিপূর্বে গাণিতিকভাবে সেকেন্ডের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পৃথিবী তার নিজ অক্ষে একবার ঘোরার সময়কে ২৪ ঘন্টায় বিভক্ত করা হয়, পরবর্তীতে প্রতি ঘন্টাকে ৬০ ভাগে ভাগ করে ১ মিনিট এবং মিনিটকে আবার ৬০ ভাগে ভাগ করে ১ সেকেন্ড নাম দেয়া হয়।
এখন এই যে সময়কে ৬০ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, এই শার্টের ধারণা কিন্তু বহু পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় সাড়ে ৩০০০ বছর পূর্বে ব্যাবলিওনরা ৬০ সিস্টেম পদ্ধতি ব্যবহার করতো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দিনের দৈর্ঘ্যকে ১২ ঘন্টায় ভাগ করা হলেও, আবার ১ ঘন্টাকে কেন ৬০ ভাগে ভাগ করা হলো? মনে করা হয়, মিশরীয়রা হাতের আঙ্গুলের হিসেবে দিনের দৈর্ঘ্যকে ১২ ভাগে ভাগ করেছিল।
এই বারোকে চাইলে বেশ কিছু ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন ২ ভাগে, ৩ ভাগে, ৪ ভাগে, এবং এমন ক্ষেত্রে কোন অবশিষ্ট থাকে না, যা হিসাবকে সহজ করত। অন্যদিকে ষাটের ক্ষেত্রেও একই বিষয়ে ষাটকে ২ ভাগে, ৩ ভাগে, ৪ ভাগে, ৫ ভাগে এমনভাবে ৬ ভাগেও ভাগ করা যায়, ফলে ওই সময় ষাটভিত্তিক হিসেবে তুলনামূলক সহজ ছিল, এবং এই জন্যই ব্যাবলিওনদের ষাটভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি সময় গণনার ক্ষেত্রে নিয়ে আসা হয়।
যাইহোক, সময়কে মিনিট, সেকেন্ডের মত ছোট এককে ভাগ করার বিষয়টি ছিল শুধুমাত্র ম্যাথমেটিক্যাল, এর প্রাকটিক্যাল কোন ইউজ ছিল না। তবে শিল্পায়ন সময়ে এসে, সময়ের এই সূক্ষ্ম অংশগুলোকে সঠিকভাবে পরিমাপের প্রয়োজন দেখা দেয়।
আরও জানুনঃ জেট ইঞ্জিন কি এবং কিভাবে কাজ করে Jet engine explained in Bangla
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেকেন্ডের মত স্বল্প সময় ব্যবধান কিভাবে গণনা করা যেতে পারে? এক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে, এমন কোন ঘটনা খুঁজে নিতে হবে, যে ঘটনার নির্দিষ্ট সময় পরপর রিপিট হয় এবং এই ঘটনার রিপিট হওয়ার সাথে সাথে ১, ২ করে সময় গণনা করা যেতে পারে। যেমন অতীতে সূর্যের আলো, মোমবাতি, পানির পাত্রের মাধ্যমে করা হয়েছিল।
এ ঘটনাগুলো ১ প্রকার বারবার রিপিট হয়, সূর্য যেমন প্রতিদিন উঠে আবার অস্ত যায়, পানির পাত্র ফাঁকা হয়ে গেলে আবার পানি দেয়া হয়।
কি? এই ধরনের ঘটনার মাধ্যমে সময় গণনার বিষয়টি পুরনো সময়ের তুলনায় যথেষ্ট হলেও পরবর্তী শিল্পীনের সময় এসে যথেষ্ট ছিল না। তখন সামনে আসে মেকানিক্যাল গিয়ারের মাধ্যমে সময় গণনা।
এক্ষেত্রে গিয়ারকে সক্রিয় রাখার ক্ষেত্রে কখনো পানি ব্যবহার করা হয়েছে, আবার কখনো গ্র্যাভিটির সাহায্য নেয়া হয়েছে, এবং এই গিয়ারের মাধ্যমে সময় গণনার বিষয়টি তুলনামূলক একুরেট ছিল।
তবে সময় গণনাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে, যখন গ্যালিলিও প্যান্ডেল আমের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। গ্যালিলিও লক্ষ্য করেন প্যান্ডেল আমের প্রত্যেকটি দুলনের ক্ষেত্রে একই সময় লাগছে, অর্থাৎ একই ঘটনা নির্দিষ্ট সময় পরপর রিপিট হচ্ছে। এবং পরবর্তীতে ক্রিস্টিয়ান হেইগেন্স প্যান্ডেল নামের এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে প্যান্ডেল অর্পণ ক্রপ তৈরি করেন। প্যান্ডেল নামের দুলন কাল্টি কোয়াল টু টু পাইলট অফ এল বাইজি।
তারমানে প্যান্ডেল নামের দুলন প্যান্ডেল নামের দুর্গের উপর নির্ভর করে এবং গ্র্যাভিটির উপর নির্ভর করে। ক্রিস্টিয়ান হেইগেন্স প্যান্ডেল নামের দুর্গ এমন পর্যায়ে নিয়ে আসেন যে, যেন প্রতি দোলনের ক্ষেত্রে ১ সেকেন্ড সময় লাগে। এবং এভাবেই তিনি তৈরি করেন প্যান্ডেল অফ লক।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, ১ সেকেন্ড আসলে কতটুকু? সেটা ক্রিস্টিয়ান হেইগেন্স কিভাবে জানলেন? ১ সেকেন্ড আসলে কতটুকু তা অতি সূক্ষ্মভাবে জানা না থাকলেও অতীতের দীর্ঘ বিজ্ঞতা থেকে এটা জানা ছিল যে ১ সেকেন্ডের ব্যক্তি কতটুকু হতে পারে। এবং সে অনুমতি তৈরি হয় প্যান্ডোলন ব্লক।
বিশেষ নিবন্ধ: বন্যা কেন হয় এবং কোন বন্যা সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর All kinds of Flood
কিন্তু এই প্যান্ডেললাম ঘড়ির ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার সামনে আসে। প্রথমত, প্যান্ডেললামের দুলন কাল প্যান্ডেলমের দুর্ঘটের সাথে সাথে গ্র্যাভিটির উপর নির্ভর করে।
এখন পৃথিবীর সকল স্থানে গ্র্যাভিটি সমান ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড², ফলে পৃথিবীর সকল প্যান্ডেল আম্পাক সমান সময়ের ব্যবধানে ভুলবেনা, ফলস্বরূপ একেকটিতে সময় গণনা একেক রকম হবে।
দ্বিতীয়ত, প্যান্ডেল এ যখন দোলে, তখনই এতে এয়ারফিকশন কাজ করে, যা প্যান্ডেললামের দুলনকে স্লো করে দেয়, ফলস্বরূপ সময় গণনা একুরেট থাকেনা।
এরপরেও কিন্তু ১৭ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত সময় গণনা ক্ষেত্রে প্যান্ডেলাম ঘড়ি ব্যবহার হয়েছে। তখন অবশ্য সবার হাতে হাতে ঘড়ি ছিল না, বিভিন্ন শহরে বড় বড় ক্লক টাওয়ার থাকত, যা থেকে মানুষ তার বাড়িতে থাকা ঘড়িতে সময় মিলিয়ে নিত। এমন ক্ষেত্রে কিন্তু সকল ঘড়ি মোটেও সিন্ক্রোনাইজ ছিল না, কোনোটা একটু দ্রুত চলতো, আবার কোনোটা আস্তে।
যদিও ওই সময়ের জন্য এটা কোনো সমস্যা ছিল না, ওই সময়ের মানুষের দৈনন্দিন কাজ করার জন্য এই ঘড়ি যথেষ্ট ছিল। তবে সমুদ্রে থাকা নাবিকের জন্য প্যান্ডেলুম ক্লক একদমই ইউসলেস ছিল, কারণ সমুদ্রের ঢেউয়ের জন্য প্যান্ডেল আমের দুলন এদিক-ওদিক হয়ে যেত, ফলস্বরূপ সময় গণনা সঠিক থাকত না।
এবং এই সমস্যার কারণে নাবিকরা কতটা দূরত্ব অতিক্রম করেছে এবং কোনদিকে যাচ্ছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারতো না। নাবিকরা তাদের অক্ষাংশ ও সূর্যের অবস্থান অনুযায়ী নির্ণয় করতে পারতো, এমনকি যে কোন অবস্থানে সূর্যের মাধ্যমে অক্ষাংশ জানা যেত। কিন্তু গভীর সমুদ্রে যাবার পর, সেই স্থানে রাগীমা বোঝার জন্য, কত বেগে কোনদিকে কত সময় যাবৎ যাত্রা করেছে তা লক্ষ্য রাখতে হতো। এবং এই বিষয়গুলো হিসেব করে রাগীমা বের করা যেত।
বিশেষ আর্টিকেল: মিটার নির্ণয় ইতিহাস Meter History and Meter Definition
কিন্তু সঠিকভাবে সময় গণনা করতে পারে এমন যন্ত্র না থাকার ফলে নাবিকরা তাদের দ্রাগিমা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারত না, যার ফলে ১৭০০ চোদ্দ সালে লুঙ্গিটিউট প্রাইজ ঘোষণা করা হয়। যা যে সঠিকভাবে সময় বলতে পারবে এমন কিছু তৈরি করতে পারলে, তাকে ওই সময়ের ২০০০০ পাউন্ড দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
তখন অনেকেই বিভিন্ন সমাধানের কথা উল্লেখ করলেও, পুরস্কার জিতেন ঘড়ি নির্মাতা জন হ্যারিসন। তিনি স্পিন ম্যাগনেটিজমের ঘড়িতে নতুন ধরনের এস্কেপমেন্ট সংযুক্ত করে একটি পকেট সাইজের ঘড়ি তৈরি করেছিলেন, যা সমুদ্রের যথেষ্ট ভালোভাবে কাজ করত এবং এই ঘড়ি যথেষ্ট একুরেট ছিল। এই ঘড়িতে একদিনে মাত্র ১ সেকেন্ড লস হতো, যা নাবিকদের জন্য যথেষ্ট কার্যকরী ছিল।
স্পিন ম্যাকানিজমের মাধ্যমে পকেট ঘড়ির ইতিহাস বহু পুরনো। সর্বপ্রথম পনেরশো ১০ সালে জার্মান ওয়াচ মেকার টিউটোরিয়াল নিন পকেট ঘড়ি বিক্রি শুরু করেন।
ঘড়ির মতো একটি যন্ত্র হাতে পরিধান করাকে ঐ সময় অসুন্দর এবং অরুচিপূর্ণ মনে করা হতো, যার ফলে পিটার পকেটের ঘড়িতে একটি চেঞ্জ যুক্ত করে বিক্রি করা শুরু করেন, যার ফলে এই ঘড়ি মানুষের পকেটে রাখতে কিংবা পার্সে রাখতে সুবিধা হতো। এবং এই জন্যই ওই সময়ের জিন্স প্যান্টে এই ছোট পকেট দেয়া হতো, যা এখনো দেখা যায়।
যাইহোক, স্প্রিং কিংবা গিয়ার ম্যাকানিজমের মাধ্যমে যত ঘড়ি তৈরি করা হোক না কেন, তা সময়ের সাথে সাথে স্লো হয়ে যায়। অর্থাৎ কিছুদিন পরপর ঘড়িতে এক্সট্রা সময় বাড়িয়ে নিয়ে ঘড়ির সময় ঠিক করে নিতে হয়, যার ফলে জন হ্যারিসনের পরবর্তী সময়ে কিভাবে ঘড়ির সময় গণনা অ্যাকুয়েড করা যায় তা নিয়ে কাজ চলে।
এবং সবচেয়ে বড় সফলতা আসে, আমেরিকান সাইন্টিস্ট ওয়ার্ল্ডে ম্যারিশনের হাত ধরে। তিনি উনিশশো ২৭ সালে কোয়ার্ক ক্লক আবিষ্কার করেন। কোয়ার্কে সিলিকনডা একসেটের ক্রিস্টাল। এই ক্রিস্টালের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে ইলেকট্রিসিটি এপ্লাই করলে কাপ্তা থাকে, অর্থাৎ কম্পিত হয় এবং এই কম্পন রেট প্রায় কনস্ট্যান্ট থাকে।
এখন ১ সেকেন্ড সময়ে কোয়ার্কে কতটি কম্পন সংকটিত হয় তা জানা গেলেই কোয়ারকের মাধ্যমে ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব, এবং এই ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে তৈরি হয় কোয়ার্ক রক।
বর্তমানে যত ধরনের ঘড়ি আমরা ব্যবহার করি, যেমন হাত ঘড়ি, দেয়াল ঘড়ি, মোবাইলের ঘড়ি, এই সব ধরনের ঘড়ি কোয়ার্কের কম্পানির মাধ্যমে গণনা করে। ঘড়ি সম্পৃক্ত যেকোনো ডিভাইসের মধ্যে এমন একটি ক্রিস্টাল অসিলেটরের সার্কিট যুদ্ধ থাকে।
যার ভেতরে একটি নির্দিষ্ট সাইজের ওয়ার্ক ক্রিস্টালের ট্রেনিং ফর্ক বসানো থাকে, যা সেকেন্ডে ৩২,৭৬৮ বার কম্পিত হয়। এর মাধ্যমে বর্তমান সময়ের ডিভাইসগুলো সময় গণনা করে থাকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ৩২,৭৬৮ বার কম্পন? কেন শুধুমাত্র ৩২,০০০ কম্পন নয়? উত্তর হচ্ছে, সেকেন্ডের অতীত সংজ্ঞা। প্রথমে সেকেন্ডের সংখ্যা ছিল একদিনে যতটুকু সময়, তার ৮৬,৪০০ ভাগের ১ ভাগ সময় হবে ১ সেকেন্ড।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একদিনে যতটুকু সময় তা সবসময় সমান থাকে না। কারণ পৃথিবী তার নিজ অক্ষে সব সময় একই স্পিডে ঘুরে না। এই স্পিড বিভিন্ন কারণে ওঠানামা করে।
এমনকি বর্তমানে পৃথিবীর যে ঘূর্ণন স্পিড, তা অতীতের তুলনায় অনেক কম। যেমন, ডেবিয়ান পিরিয়ডে পৃথিবীর ঘূর্ণন স্পিড এত ছিল যে তখন ১ বছরে পৃথিবী নিজ অক্ষে ৪১২ বার ঘুরতো। অর্থাৎ তখন ২২ ঘণ্টায় একদিন হতো।
সেই অবস্থা থেকে স্পিড কমতে কমতে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কমবে। তবে এই স্পিড কমার বিষয়টি খুবই ধীর প্রক্রিয়া। এখন পৃথিবী নিজ অক্ষে ঘূর্ণনের বিষয়টি যেহেতু কনস্ট্যান্ট নয়, ফলে পরবর্তীতে সেকেন্ডকে সূর্য বছরের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরতে যে সময় নেয়, তার ৩১,৫৫৬,৯২৫.৯৭৪৭ ভাগের ১ ভাগ সময়কে বলা হবে সেকেন্ড। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। বিভিন্ন গ্রহের গ্র্যাভিটি, অ্যাস্টেরয়েডসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার সময়টা কনস্ট্যান্ট থাকে না। দেখা যায়, কয়েক হাজার বছরের ব্যবধানে এই সময়টা কয়েক সেকেন্ড এদিক-সেদিক হয়।
যার ফলে এর মাধ্যমেও সেকেন্ডকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এখন সূর্য বছর অনুযায়ী সেকেন্ডের ব্যপ্তি কতটুকু হবে তা আমরা জানি। কিন্তু এই সময়টুকুকে এমন কিছুর মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ মূল কথা হচ্ছে, আমরা সময়ের এমন একটি ইউনিট বেছে নিব যা অপরিবর্তনশীল কোনো কিছুর মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
কিন্তু কোয়ার্টজ ক্রিস্টালের মাধ্যমে সেই সংজ্ঞা সম্ভব নয়। কারণ কোয়ার্টজ ক্রিস্টালকে একটি নির্দিষ্ট সাইজে কাটলেই কেবল এটি সেকেন্ডে ৩২,৭৬৮ বার কাঁপবে। এই সাইজ থেকে কমবেশি হলেই কম্পনের সংখ্যাও এদিক-সেদিক হয়ে যাবে। এছাড়াও কোয়ার্টজের কম্পন তাপ ও চাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
কোয়ার্টজ ক্রিস্টালের মাধ্যমে তৈরি করা ঘড়ি প্রতি বছরে ১ থেকে ২৫ সেকেন্ড পর্যন্ত সময় লস হতে পারে। তার মানে কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য যথেষ্ট হলেও, টেকনোলজি এবং সেকেন্ডের সংজ্ঞার জন্য এটি পারফেক্ট নয়।
তখন সামনে আসে অ্যাটমিক ক্লক। পরমাণুর কম্পনের মাধ্যমে সময় গণনাকে বলা হয় অ্যাটমিক ক্লক। বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী, সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণুর ৯,১৯২,৬৩১,৭৭০ বার স্পন্দন সম্পূর্ণ হতে যে সময় লাগে, তাই হচ্ছে ১ সেকেন্ড।
এখন এই বিষয়টি বুঝতে হলে সিজিয়াম পরমাণুর দিকে লক্ষ্য করতে হবে। সিজিয়াম পরমাণুর সর্বশেষ কক্ষপথে একটি ইলেকট্রন থাকে। এই ইলেকট্রন একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন শোষণ করতে পারে।
প্রথমে সিজিয়াম পরমাণুকে বাষ্পে পরিণত করা হয়। তারপর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মাধ্যমে হাই এনার্জি ইলেকট্রনকে আলাদা করে শুধুমাত্র লো এনার্জি ইলেকট্রনকে এই মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনের মধ্যে দিয়ে চালনা করা হয়।
লো এনার্জি ইলেকট্রন যেহেতু শুধুমাত্র এই ফ্রিকোয়েন্সির মাইক্রোওয়েভ শোষণ করতে পারে, ফলে এটি মাইক্রোওয়েভ শোষণ করে হাই এনার্জি ইলেকট্রনে পরিণত হয়। এই হাই এনার্জি ইলেকট্রন ডিটেক্টরে এসে তার শোষিত এনার্জি রিলিজ করে।
এখন ইলেকট্রন যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এনার্জি শোষণ করেছিল, তা নির্গত করে। যা আবার প্রথমে দেওয়া মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনের সাথে যুক্ত করা থাকে। অর্থাৎ এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া।
তাহলে খেয়াল করুন, এটি একটি পর্যায়ক্রমিক ঘটনা। নির্দিষ্ট সময় পরপর এটি ঘটে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় পরপর ডিটেক্টর হাই এনার্জি ইলেকট্রনকে শনাক্ত করে। এর ফলে সময় গণনা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে নির্ভুল হয়।
এখানে আরেকটি বিষয় খেয়াল করুন। এই মাইক্রোওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি যদি সামান্য এদিক-সেদিক হয়, তবে লো এনার্জি ইলেকট্রন হাই এনার্জি ইলেকট্রনে পরিণত হবে না। ফলাফল, ডিটেক্টর ইলেকট্রন শনাক্ত করতে পারবে না।
অর্থাৎ কোনো কারণে অ্যাটমিক ক্লক যদি সঠিক ছন্দে না থাকে, তখন এটি সময় গণনা করবে না। এমন ক্ষেত্রে সামান্য অ্যাক্সিডেন্টাল পাওয়ার দিলেই ঘড়ি ছন্দে চলে আসে।
এই কারণেই অ্যাটমিক ক্লক একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম সময় গণনা যন্ত্র। এটি এতটাই নির্ভুল যে ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি বছরে মাত্র ১ সেকেন্ড লস করে।
বর্তমানে অবশ্য উত্তপ্ত পরমাণুর পরিবর্তে অতি ঠাণ্ডা পরমাণু ব্যবহার করা হয়, যাতে নির্ভুলতা আরও বেশি পাওয়া যায়। এমনকি সম্প্রতি আরও নির্ভুল সময় গণনার জন্য মাইক্রোওয়েভের পরিবর্তে ভিজিবল লাইট বা লেজার ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। যা বর্তমানের অ্যাটমিক ক্লকের চেয়েও আরও বেশি নির্ভুল হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এতটা নির্ভুল ঘড়ির প্রয়োজন কী?
আসলে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে এতটা নির্ভুল ঘড়ির প্রয়োজন না হলেও, প্রতিদিনকার জীবনে ব্যবহার করা টেকনোলজি এতটা নির্ভুল ক্লক ছাড়া অসম্ভব।
বর্তমানে কোটি কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি ফোন কল করা হচ্ছে। এই সকল টেকনোলজি অ্যাটমিক ক্লকের মতো নির্ভুল সময় ছাড়া অসম্ভব।
আপনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যে ডাটা পাঠাচ্ছেন বা ফোন কল করছেন, এর জন্য দুই স্থানের সময় একদম সঠিকভাবে সিঙ্ক্রোনাইজ থাকতে হবে। তা না হলে দ্রুতগতির ইন্টারনেট কিংবা স্মুথ ফোন কল সম্ভব হবে না।
কারণ, এসকল সিগন্যাল আলোর গতিতে ট্রাভেল করে এবং এই গতিতে সময়ের অতি সূক্ষ্ম এদিক-সেদিক বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করবে।
আসলে মূল কথা হচ্ছে, বর্তমানের আধুনিক প্রযুক্তি একুরেট টাইম সিঙ্ক্রোনাইজেশন ছাড়া অসম্ভব। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অ্যাটমিক ক্লক বসানো রয়েছে। এমনকি মহাকাশেও অ্যাটমিক ক্লক রাখা হয়েছে এবং এরা পরস্পরের সাথে সিঙ্ক্রোনাইজ রয়েছে।
অ্যাটমিক ক্লকের অতি সূক্ষ্ম সময় গণনার ফলে পৃথিবীর গতি অনুযায়ী যে সেকেন্ড, তা এই অ্যাটমিক ক্লকের সেকেন্ডের সাথে সমন্বয় করতে পারে না। যার ফলে মাঝে মাঝে বিভিন্ন রেফারেন্স সময়ের সাপেক্ষে পৃথিবীর গতির সাথে যেন অ্যাটমিক ক্লকের একটি সমন্বয় থাকে, এর জন্য অ্যাটমিক ক্লকে ১ লিপ সেকেন্ড যোগ করা হয়।
যেমন, সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর অ্যাটমিক ক্লকে ১ সেকেন্ড যোগ করা হয়েছিল।
আমরা যতটুকু দৈর্ঘ্যকে মিটার বিবেচনা করি, ততটুকুই কেন মিটার হলো? কেন এর চেয়ে কম বা বেশি হলো না?
কতটুকু দৈর্ঘ্যকে মিটার বিবেচনা করা হবে, তা নির্ণয়ের জন্য ১৭৯১ সালে একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নেওয়া হয়েছিল। সাত বছরের পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছিল, কতটুকু দৈর্ঘ্যকে মিটার বিবেচনা করা হবে।
এই মিটার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে, এই ভিডিওটি দেখতে পারেন। ভিডিও ভালো লাগলে বিজ্ঞান পাইছি পরিবারে যুক্ত হয়ে সাথে থাকতে পারেন।
Comments ৪